পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কথা আপনার অর্থকে পার হইয়া যায়। যাহা বলে তার চেয়ে বেশি বলে। এই ব্যঞ্জনা ব্যক্ত ও অব্যক্তর মাঝখানকার মীড়। কবির কাব্যে এই ব্যঞ্জনা বাণীর নির্দিষ্ট অর্থের দ্বারা নহে, বাণীর অনির্দিষ্ট ভঙ্গির দ্বারা, । অর্থাৎ বাণীর রেখার দ্বারা নহে, তাহার রঙের দ্বারা সৃষ্ট হয়। আসল কথা, সকল প্রকৃত আর্টেই একটা বাহিরের উপকরণ, আর-একটা চিত্তের উপকরণ থাকা চাইঅর্থাৎ একটা রূপ,আর-একটা ভাব। সেই উপকরণকে সংযমের দ্বারা বাধিয়া গাড়িতে হয় ; বাহিরের ধাধন প্রমাণ, ভিতরের বাধন লাবণ্য। তার পরে সেইভিতর বাহিরের উপকরণকে মিলাইতে হইবে কিসের জন্য ? সাদৃশ্যের জন্য। কিসের সঙ্গে সাদৃশ্য ? না, ধ্যানরূপের সঙ্গে কল্পরূপের সঙ্গে সাদৃশ্য। বাহিরের রূপের সঙ্গে সাদৃশ্যই যদি মুখ্য লক্ষ্য হয় তরে ভাব ও লাবণ্য কেবল যে অনাবশ্যক হয় তাহা নহে, তাহা বিরুদ্ধ হইয়া দাঁড়ায়। এই সাদৃশ্যটিকে ব্যঞ্জনার রঙে রঙইতে পারলে সোনায় সোহাগা— কারণ তখন তাহা সাদৃশ্যের চেয়ে বড়ো হইয় ওঠে- তখন তাহা কতটা যে বলিতেছি। তাহা স্বয়ং রচয়িতাও জানে না- তখন সৃষ্টকর্তার সৃষ্টি তাহার সংকল্পকেও ছাড়াইয়া যায়। অতএব, দেখা যাইতেছে। ছবির যে ছয় অঙ্গ, সমস্ত আর্টের অর্থাৎ আনন্দরূপেরই তাই। S\) NR সোনার কাঠি রূপকথায় আছে, রাক্ষসের জাদুতে রাজকন্যা ঘুমিয়ে আছেন। যে পুরীতে আছেন সে সোনার পূরী, যে পালঙ্কে শুয়েছেন সে সোনার পালঙ্ক ; সোনা মানিকের অলংকারে ঠার গা ভরা। কিন্তু কড়াক্কড় পাহারা, পাছে কোনো সুযোগে বাহিরের থেকে কেউ এসে তার ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। তাতে দোষ কী ? দোষ এই যে, চেতনার অধিকার যে বড়ো। সচেতনকে যদি বলা যায় তুমি কেবল এইটুকুর মধ্যেই চিরকাল থাকবে, তার এক পা বাইরে যাবে না, তাহলে তার চৈতন্যকে অপমান করা হয়। ঘুমপাড়িয়ে রাখার সুবিধা এই যে তাতে দেহের প্রাণটা টিকে থাকে। কিন্তু মনের বেগটা হয় একেবারে বন্ধ হয়ে যায়, নয়। সে অদ্ভুত স্বপ্নের পথহীন ও লক্ষ্যহীন অন্ধলোকে বিচরণ করে । আমাদের দেশের গীতিকলার দশটা এইরকম। সে মোহ-রাক্ষসের হাতে পড়ে বহুকাল থেকে ঘুমিয়ে আছে। যে ঘরটুকু যে পালঙ্কটুকুর মধ্যে এই সুন্দরীর স্থিতি তার ঐশ্বর্যের সীমা নেই ; চারিদিকে কারুকার্য সে কত সূক্ষ্ম কত বিচিত্র ! সেই চড়ির দল, যাদের নাম ওস্তাদি, তাদের চােখে ঘুম নেই ; তারা শত শত বছর ধরে সমস্ত আসা-যাওয়ার পথ আগলে বসে আছে, পাছে বাহির থেকে কোনাে আগন্তুক এসে ঘুম ভাঙিয়ে দেয় । ܝ তাতে ফল হয়েছে এই যে, যে কালটা চলছে রাজকন্যা তার গলায় মালা দিতে পারে নি, প্রতিদিনের নূতন নূতন ব্যবহারে তার কোনাে যোগ নেই। সে আপনার সৌন্দর্যের মধ্যে বন্দী, ঐশ্বর্যের মধ্যে অচল। কিন্তু তার যত ঐশ্বৰ্য যত সৌন্দর্যই থাক তার গতিশক্তি যদি না থাকে তাহলে চলতি কাল তার ভারবহন করতে রাজি হয় না। একদিন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে পালঙ্কের উপর অচলাকে শুইয়ে রেখে সে আপন পথে চলে যায়- তখন কালের সঙ্গে কলার বিচ্ছেদ ঘটে। তাতে কালেরও দারিদ্র্য, কলারও বৈকল্য। আমরা স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি। আমাদের দেশে গান জিনিসটা চলছে না। ওস্তাদরা বলছেন, গান জিনিসটা তো চলাবার জন্যে হয় নি, সে বৈঠকে বসে থাকবে তোমরা এসে সমের কাছে খুব জোরে মাথা নেড়ে যাবে ; কিন্তু মুশকিল। এই যে, আমাদের বৈঠকখানার যুগ চলে গেছে, এখন আমরা যেখানে একটু বিশ্রাম করতে পাই সে মুসাফিরখানায়। যা-কিছু স্থির হয়ে আছে তার খাতিরে আমরা স্থির হয়ে থাকতে পারব না। আমরা যে নদী বেয়ে চলছি সে নদী চলছে, যদি নীেকোটা না চলে তবে খুব দামি নীেকো হলেও তাকে ত্যাগ করে