পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিচয় V89 ছন্দগুলি নানা ভঙ্গিতে হিল্লোলিত হয়। এই সমস্ত অবকাশবহুল রঙিন শব্দ যদি না থার্কিত তবে বুদ্ধির কোনাে ক্ষতি হইত না কিন্তু হৃদয় যে বিনা প্রকাশে বুক ফাটিয়া মরিত। অনির্বচনীয়কে লইয়া তাহার প্রধান কারবার ; এইজন্য অর্থেতাহার অতি সামান্য প্রয়োজন। বুদ্ধির দরকার গতিতে, কিন্তু হৃদয়ের দরকার নৃত্যে। গতির লক্ষ্য- একাগ্ৰহইয়া লাভ করা, নৃত্যের লক্ষ্য-বিচিত্র হইয়া প্রকাশ করা। ভিড়ের মধ্যে ভিড়িয়াও চলা যায় কিন্তু ভিড়ের মধ্যে নৃত্যু করা যায় না। নৃত্যের চারিদিকে অবকাশ চাই। এইজন্য হৃদয় অবকাশ দাবি করে। বুদ্ধিমান তাহার সেই দাবিটাকে অবাস্তব এবং তুচ্ছ বলিয়া উড়াইয়া দেয়। আমি বৈজ্ঞানিক নহি কিন্তু অনেকদিন ছন্দ লইয়া ব্যবহার করিয়াছি বলিয়া ছন্দের তত্ত্বটা কিছু বুঝি বলিয়া মনে হয়। আমি জানি ছন্দের যে অংশটাকে যতি বলে অর্থাৎ যেটা ফাক, অর্থাৎ ছন্দের বস্তু অংশ যেখানে নাই সেইখানেই ছন্দের প্রাণ- পৃথিবীর প্রাণীটা যেমন মাটিতে নহে, তাহার বাতাসেই। ইংরেজিতে যতিকে বলে।pause-কিন্তু pause শব্দে একটা অভাব সূচনা করে, যতি সেই অভাব নহে। সমস্ত ছন্দের ভাবটাই ঐ যতির মধ্যে- কারণ যতি ছন্দকে নিরস্ত করে না, নিয়মিত করে । ছন্দ যেখানে যেখানে থামে সেইখানেই তাহার ইশারা ফুটিয়া উঠে, সেইখনেই সে নিশ্বাস ছাড়িয়া আপনার পরিচয় দিয়া বীচে। এই প্রমাণটি হইতে আমি বিশ্বাস করি বিশ্বরচনায় কেবলই যে সমস্ত যতি দেখা যায় সেইখানে শূন্যতা নাই, সেইখানেই বিশ্বের প্রাণ কাজ করিতেছে। শুনিয়াছি অণুপরমাণুর মধ্যে কেবলই ছিদ্ৰ- আমি নিশ্চয় জানি সেই ছিদ্রগুলির মধ্যেই বিরাটের অবস্থান। ছিদ্রগুলিই মুখ্য, বস্তুগুলিই গীেশ । যাহাকে শূন্য বলি বস্তুগুলি তাঁহারই অশ্রান্ত লীলা। সেই শূন্যই তাহাদিগকে আকার দিতেছে, গতি দিতেছে, প্ৰাণ দিতেছে। আকর্ষণ বিকর্ষণ তো সেই শূন্যেরই কুস্তির প্যাচ। জগতের বস্তুব্যাপার সেই শূন্যের, সেই মহাযাতির পরিচয় । এই বিপুল বিচ্ছেদের ভিতর দিয়াই জগতের সমস্ত যোগসাধন হইতেছে- অণুর সঙ্গে অণুর, পৃথিবীর সঙ্গে সূর্যের, নক্ষত্রের সঙ্গে নক্ষত্রের। সেই বিচ্ছেদমহাসমুদ্রের মধ্যে মানুষ ভাসিতেছে বলিয়াই মানুষের শক্তি, মানুষের জ্ঞান, মানুষের প্রেম, মানুষের যত কিছু লীলাখেলা। এই মহাবিচ্ছেদ যদি বস্তুতে নিরেট হইয়া ভরিয়া যায়। তবে একেবারে নিবিড় একটানা মৃত্যু। মৃত্যু আর কিছু নহে- বস্তু যখন আপনার অবকাশকে হারায় তখন তাঁহাই মৃত্যু। বস্তু তখন যেটুকু কেবলমাত্র সেইটুকুই, তার বেশি নয়। প্রাণ সেই মহাঅবকাশ-যাহাকে অবলম্বন করিয়া বস্তু আপনাকে কেবলই আপনি ছাড়াইয়া চলিতে পারে। বস্তুবাদীরা মনে করে অবকাশটা নিশ্চল কিন্তু যাহারা অবকাশরসের রসিক তাহারা জানে বস্তুটাই নিশ্চল, অবকাশই তাঁহাকে গতি দেয়। রণক্ষেত্রে সৈন্যের অবকাশ নাই; তাহারা কাধে কাধ মিলাইয়া বািহরচনা করিয়া চলিয়ছে, তাহারা মনে ভাবে আমরাই যুদ্ধ করিতেছি। কিন্তু যে-সেনাপতি অবকাশে নিমগ্ন হইয়া দূর হইতে স্তব্ধভাবে দেখিতেছে, সৈন্যদের সমস্ত চলা তাহারই মধ্যে। নিশ্চলের যে ভয়ংকর চলা তাহার রুদ্রবেগ যদি দেখিতে চাও তবে দেখো ঐ নক্ষত্রমণ্ডলীর আবর্তনে, দেখে যুগ-যুগান্তরের তাণ্ডব নৃত্যে। যে নাচিতেছে না। তাহারই নাচ এই সকল চঞ্চলতায় । এত কথা যে বলিতে হইল। তাহার কারণ, কবিশেখর কালিদাস যে আষাঢ়কে আপনার মন্দাক্রান্তাচ্ছদের অম্লান মালাটি পরাইয়া বরণ করিয়া লইয়াছেন তাহাকে ব্যস্ত-লোকেরা ‘আষাঢ়ে বলিয়া অবজ্ঞা করে। তাহারা মনে করে এই মেঘাবগুষ্ঠিত বর্ষণ মীর-মুখর মাসটি সকল কাজের বাহির, ইহার ছায়াবৃত্ব প্রহরগুলির পসরায় কেবল বাজে কথার পণ্য। অন্যায় মনে করে না। সকল কাজের বাহিরের যে দলটি যে অহৈতুকী স্বৰ্গসভায় আসন লইয়া বাজে-কথার অমৃত পান করিতেছে, কিশোর আষাঢ় যদি আপন আলোল কুম্ভলে নবমালতীর মালা জড়াইয়া সেই সভার নীলকান্তমণির পেয়াল ভরিবার ভার লইয়া থাকে, তবে স্বাগত, হে নবঘনশ্যাম, আমরা তোমাকে অভিবাদন করি। এসো এসো জগতের যত অকৰ্মণ্য, এসো এসো ভাবের ভাবুক, রসের রসিক-আবাঢ়ের মৃদঙ্গ ঐ বাজিল, এসোস্যমন্ত খ্যাপার দল, তোমাদের নাচের ডাক পড়িয়ছে। বিশ্বের চির-বিরহবেদনার অশ্রু উৎস আজ খুলিয়া গেল, আজ তাহা আর মানা মানিল না। এসো গো অভিসারিকা, কাজের সংসারে কপট পড়িয়াছে, হ্যািটর পথে লোক নাই, চকিত বিদ্যুতের