পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কর্তার ইচ্ছায় কর্ম \ይ(፩ዓ ইংরেজ-রাষ্ট্রনীতির মূলতত্ত্বই রাষ্ট্ৰতন্ত্রের সঙ্গে প্রজাদের শক্তির যোগ। এই রাষ্ট্ৰতন্ত্র চিরদিনই একতরফা আধিপত্যের বুকে শেল হানিয়ছে, এ কথা আমাদের কাছেও কিছুমাত্র ঢাকা নাই। এই কথাই সরকারি বিদ্যালয়ে আমরা সদরে বসিয়া পড়ি, শিখি, এবং পড়িয়া এগজামিন পাস করি। এ কথাটাকে এখন আমাদের কােছ হইতে ফিরাইয়া লইবার আর উপায় নাই। কনগ্রেস বল, লীগ বল, এ-সমস্তর মূলই এইখানে। যেমন যুরোপীয় সায়ালে আমাদের সকলেরই অধিকারটা সেই সায়ন্সেরই প্রকৃতিগত, তেমনি ইংরেজ-রাষ্ট্ৰতন্ত্রে ভারতের প্রজার আপনি অধিকার সেই রাষ্ট্রনীতিরই জীবনধর্মের মধ্যেই। কোনাে একজন বা দশজন বা পঁচিশজন ইংরেজ বলিতে পারে, ভারতীয় ছাত্রকে সায়ান্স শিখিবার সুযোগটা না দেওয়াই ভালো, কিন্তু সায়াল সেই পাঁচশো ইংরেজের কণ্ঠকে লজ্জা দিয়া ব্যঞ্জস্বরে বলিবে, ‘এসো তােমরা, তোমাদের বর্ণ যেমনি হােক, তােমাদের দেশ যেখানেই থাক, আমাকে গ্ৰহণ করিয়া শক্তি লাভ করো।” তেমনি কোনো দশজন বা দশহাজারজন ইংরেজ রাজসভার মঞ্চে বা খবরের কাগজের স্তম্ভে চড়িয়া বলিতেও পারে যে, ভারতশাসনতন্ত্রে ভারতীয় প্রজার কর্তৃত্বকে নানাপ্রকারে প্রবেশে বাধা দেওয়াই ভালো, কিন্তু সেই দশহাজার ইংরেজের মন্ত্রণাকে তিরস্কার করিয়া ইংরেজের রাষ্ট্রনীতি বজ্ৰস্বরে বলিতেছে, ‘এসো তােমরা, তােমাদের বর্ণ যেমনি হােক, তােমাদের দেশ যেখানেই থাক ভারতশাসনতন্ত্রে ভারতীয় প্রজার আপনি অধিকার আছে, তাহা গ্ৰহণ করো ।” কিন্তু ইংরেজের রাষ্ট্রনীতি আমাদের বেলায় খাটে না, এমন একটা কড়া জবাব শুনিবার আশঙ্কা আছে। ভারতবর্ষে ব্ৰাহ্মণ যেমন বলিয়ছিল উচ্চতর জ্ঞানে ধর্মেকর্মে শূদ্রের অধিকার নাই, এও সেই রকমের কথা । কিন্তু ব্ৰাহ্মণ এই অধিকারভেদের ব্যবস্থাটাকে আগাগােড়া পাকা করিয়া গাঁথিয়াছিল— যাহাকে বাহিরে পঙ্গু করিবে তার মনকেও পঙ্গু করিয়াছিল। জ্ঞানের দিকে গোড়া কাটা পড়িলেই কর্মের দিকে ডালপালা। আপনি শুকাইয়া যায়। শূদ্রের সেই জ্ঞানের শিকড়টা কাটিতেই আর বেশি কিছু করিতে হয় নাই ; তার পর হইতে তার মাথাটা আপনিই নুইয়া পড়িয়া ব্ৰাহ্মণের পদব্রজে আসিয়া ঠেকিয়া রহিল। ইংরেজ আমাদের জ্ঞানের দ্বার বন্ধ করে নাই, অথচ সেইটেই মুক্তির সিংহদ্বার। রাজপুরুষেরা সেজন্য বোধ করি মনে মনে আপসোস করেন এবং আস্তে আস্তে বিদ্যালয়ের দুটাে-একটা জানলদরজাও বন্ধ করিবার গতিক দেখি, কিন্তু তবু এ কথা তঁরা কোনোদিন একেবারে ভুলিতে পরিবেন না যে, সুবিধার খাতিরে নিজের মনুষ্যত্বকে আঘাত করিলে ফলে সেটা আত্মহত্যার মতোই হয় । ভারতশাসনে আমাদের ন্যায্য অধিকারটা ইংরেজের মনস্তত্ত্বের মধ্যেই নিহিত- এই আশার কথােটাকে যদি আমাদের শক্তি দিয়া ধরিতে পারি। তবে ইহার জন্য বিস্তর দুঃখ সহা, ত্যাগ করা, আমাদের পক্ষে সহজ হয়। যদি আমাদের দুর্বল অভ্যাসে বলিয়া বসি, কর্তার ইচ্ছা কর্ম, ওর আর নড়াচড় নাই, তবে যে সুগভীর নৈরাশ্য আসে, তার দুই রকমের প্রকাশ দেখিতে পাই- হয় গোপনে চক্রান্ত করিয়া আকস্মিক উপদ্রবের বিস্তার করিতে থাকি, নয় ঘরের কোণে বসিয়া পরস্পরের কানে-কানে বলি, অমুক লাটসাহেব ভালো কিংবা মন্দ, অমুক ব্যক্তি মন্ত্রিসভায় সচিব থাকিতে আমাদের কল্যাণ নাই, মর্লি সাহেব ভারতসচিব হইলে হয়তো । আমাদের সুদিন হইবে, নয়তো আমাদের ভাগে এই বিড়াল বনে গিয়া বনবিড়াল হইয়া উঠিবে। অর্থাৎ নৈরাশ্যে, হয় আমাদের মাটির তলার সুড়ঙ্গের মধ্যে ঠেলিয়া শক্তির বিকার ঘটায়, নয় গৃহকোণের বৈঠকে বসাইয়া শক্তির ব্যর্থতা সৃষ্টি করে ; হয় উন্মাদ করিয়া তোলে, নয়। হাবা করিয়া রাখে। কিন্তু মনুষ্যত্বকে অবিশ্বাস করিব না ; এমন জোরের সঙ্গে চলিব, যেন ইংরেজরাষ্ট্রনীতির মধ্যে কেবল শক্তিই সত্য নহে, নীতি তার চেয়ে বড়ো সত্য। প্রতিদিন তার বিরুদ্ধতা দেখিব; দেখিব স্বার্থপরতা, ক্ষমতাপ্রিয়তা, লোভ, ক্ৰোধ, ভয় ও অহংকার সমস্তরই লীলা চলিতেছে ; কিন্তু মানুষের এই রিপুগুলো সেইখনেই আমাদের মারে যেখানে আমাদের অন্তরেও রিপু আছে, যেখানে আমরাও ক্ষুদ্র ভয়ে ভীত, ক্ষুদ্র লোভে লুব্ধ, যেখানে আমাদের পরস্পরের প্রতি ঈর্ষা বিদ্বেষ অবিশ্বাস। যেখানে আমরা বড়ো, আমরা বীর, আমরা ত্যাগী তপস্বী শ্রদ্ধাবান, সেখানে অন্যপক্ষে যাহা মহৎ তার সঙ্গে আমাদের সত্য যোগ হয় ; সেখানে অন্য পক্ষের রিপুর মারা খাইয়াও তবু আমরা জয়ী হই, বাহিরে না হইলেও অন্তরে। আমরা যদি ভিতু হই, ছােটাে হই, তবে ইংরেজগবর্মেন্টের নীতিকে খাটাে করিয়া তার রিপুটাকেই প্রবল করিব। যেখানে দুই পক্ষ