পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কর্তার ইচ্ছায় কর্ম Ved আপনি বাহন, সকলের পথকে আপনি কাটেন, ধারা সমস্ত বিরুদ্ধতার মধ্যেও মনুষ্যত্বকে বিশ্বাস করেন এবং ব্যৰ্থতার গভীরতম অন্ধকারের পূর্বপ্রান্তে অরুণোদয়ের প্রতীক্ষায় জাগিয়া থাকেন। তঁরা অবিশ্বাসীর সমস্ত ‘স্বল্পমপাস ধর্মস ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ।' অর্থাৎ কেন্দ্ৰস্থলে যদি স্বল্পমাত্রও ধর্ম থাকে। তবে পরিধির দিকে রাশি রাশি ভয়কেও ভয় করিবার দরকার নাই। রাষ্ট্ৰতত্ত্বে নীতি যদি কোনোখানেও থাকে। তবে তাহাকেই নমস্কার-ভীতিকে নয়। ধর্ম আছে, অতএব মরা পর্যন্ত মানিয়াও তাঁহাকে মানিতে হইবে । মনে করো ছেলের শক্ত ব্যামো। সেজন্য দূর হইতে স্বয়ং ইংরেজ সিভিল সার্জনকে আনিয়াছি। খরচ বড়ো কম করি নাই। যদি হঠাৎ দেখি তিনি মন্ত্ৰ পড়িয়া মারিয়াধরিয়া ভূতের ওঝার মতাে বিষম ঝাড়াবুড়ি শুরু করিলেন, রোগীর আত্মাপুরুষ ত্ৰাহি ত্ৰাহি করিতে লাগিল। তবে ডাক্তারকে জোর করিয়াই বলিব, ‘দোহাই সাহেব, ভূত ঝাড়াইবেন না, চিকিৎসা করুন।’ তিনি চােখ রাঙাইয়া বলিতে পারেন, “তুমি কে হে! আমি ডাক্তার যাই করি।-না তাই ডাক্তারি।” ভয়ে যদি বুদ্ধি দমিয়া না যায়। তবে তঁাকে আমার এ কথা বলিবার অধিকার আছে “যে ডাক্তারি-তত্ত্ব লইয়া তুমি ডাক্তার আমি তাকে তোমার চেয়ে বড়ো বলিয়াই জানি, তার মূল্যেই তোমার মূল্য ।” এই যে অধিকার এর সকলের চেয়ে বড়ো জোর ঐ ডাক্তার সম্প্রদায়েরই ডাক্তারিশাস্ত্রে এবং ধর্মনীতির মধ্যে । ডাক্তার যতই আস্ফালন করুক এই বিজ্ঞান এবং নীতির দোহাই মানিলো লজ্জা না পাইয়া সে থাকিতেই পারে না। এমনকি, রাগের মুখে সে আমাকে ঘুষিও মারিতে পারে- কিন্তু তবু আস্তে আস্তে আমার সেলাম এবং সেলামিট পকেটে করিয়া গাড়িতে বসার চেয়ে এই ঘুষির মূল্য বড়ো। এই ঘুষিতে সে আমাকে যত মারে নিজেকে তার চেয়ে বেশি মারে । তাই বলিতেছি, যে-কথাটা ইংরেজের কথা নয় কেবলমাত্র ইংরেজ আমলাদের কথা, সে-কথায় যদি আমরা সায় না দিই। তবে আজ দুঃখ ঘটিতে পারে। কিন্তু কাল দুঃখ কাটিবে। দেড়শো বছর ভারতে ইংরেজ শাসনের পর আজ এমন কথা শোনা গেল, মাদ্রাজ গবমেন্ট ভালোমন্দ যাই করুক বাংলাদেশে তা লইয়া দীর্ঘনিশ্বাসটি ফেলিবার অধিকার বাঙালির নাই। এতদিন এই জানিতাম, ইংরেজের অখণ্ড শাসনে মাদ্রাজ বাংলা পাঞ্জাব মারাঠা ভিতরে বাহিরে এক হইয়া উঠিতেছে এই গৌরবই ইংরেজ সাম্রাজ্যের মুকুটের কোহিনুর মণি। বেলজিয়াম ও ফ্রান্সের দুৰ্গতিকে আপনি দুৰ্গতি মনে করিয়া ইংরেজ যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিতে ছুটিয়াছে, সমুদ্রের পশ্চিম পারে যখন এই বার্তা তখন সমুঞ্জের পূর্ব পারে এমন নীতি কি একদিনও খাটিবে যে, মাদ্রাজের ভালোমন্দ সুখ-দুঃখে বাঙালির কোনো মাথাব্যথা নাই ? এমন হুকুম কি আমরা মাথা হেঁট করিয়া মানিব ? এ কথা কি নিশ্চয় জানি না যে, মুখে এই হুকুম যত জোরেই হাকা হউক অন্তরে ইহার পিছনে মস্ত একটা লজ্জা আছে ? ইংরেজের সেই অন্যায়ের গোপন লজ্জা আর আমাদের মনুষ্যত্বের প্রকাশ্য সাহস- এই দুয়ের মধ্যে মিল করিতে হইবে। ইংরেজ ভারতের কাছে সত্যে · বদ্ধ ; ইংরেজ যুরোপীয় সভ্যতার দায়িত্ব বহিয়া এই পূর্ব দেশে আসিয়াছে; সেই সভ্যতার বাণীই তাহার প্রতিশ্রুতি বাণী । সেই দলিলকেই আমরা সব চেয়ে বড়ো দলিল করিয়া চলিব, এ কথা তাকে কখনোই বলিতে দিব না যে, ভারতবর্ষকে আমরা টুকরা টুকরা করিয়া মাছকটা করিবার জন্যই সমুদ্র পার হইয়া আসিয়াছি । যে-জাতি কোনো বড়ো সম্পদ পাইয়াছে সে তাহা দেশে দেশে দিকে দিকে দান করিবার জন্যই পাইয়াছে। যদি সে কৃপণতা করে তবে সে নিজেকেই বঞ্চিত করবে। য়ুরোপের প্রধান সম্পদ বিজ্ঞান এবং জনসাধারণের ঐক্যবােধ ও আত্মকর্তৃত্ব লাভ। এই সম্পদ এই শক্তি ভারতকে দিবার মহৎ দায়িত্বই ভারতে ইংরেজ শাসনের বিধিদত্ত রাজ-পরোয়ানা। এই কথা শাসনকর্তাদের স্মরণ করাইবার ভার আমাদের উপরেও আছে। কারণ, দুই পক্ষের যোগ না হইলে বিস্মৃতি ও বিকার ঘটে । ইংরেজ নিজের ইতিহাসের দোহাই দিয়া এমন কথা বলিতে পারে- জনসাধারণের আত্মকর্তৃত্বটি যে