পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ዓለob” রবীন্দ্র-রচনাবলী ‘যৌবনের আরম্ভ-সময়ে বাংলাদেশে ফিরে এলেম । সেই ছাদ, সেই চাদ, সেই দক্ষিনে বাতাস, সেই নিজের মনের বিজন স্বপ্ন, সেই ধীরে ধীরে ক্রমে ক্ৰমে চারি দিক থেকে প্রসারিত সহস্ৰ বন্ধন, সেই সুদীর্ঘ অবসর, কর্মহীন কল্পনা, আপন মনে সৌন্দর্যের মরীচিকা রচনা, নিস্ফল দুরাশা, অন্তরের নিগুঢ় বেদনা, আত্মপীড়ক অলস কবিত্ব-এই সমস্ত নাগপাশের দ্বারা জড়িত বেষ্টিত হয়ে চুপ করে পড়ে আছি। আজ আমার চার দিকে নবজীবনের প্রবলতা ও চঞ্চলতা দেখে মনে হচ্ছে, আমারও হয়তো এরকম হতে পারত। কিন্তু আমরা সেই বহুকাল পূর্বে জন্মেছিলেম- তিনজন বালক- তখন পৃথিবী আর-একরকম ছিল । এখনকার চেয়ে অনেক বেশি অশিক্ষিত, সরল, অনেক বেশি কাচা ছিল । পৃথিবী আজকালকার ছেলের কাছে Kindergarten-এর কত্রীর মতো— কোনো ভুল খবর দেয় না, পদে পদে সত্যকার শিক্ষাই দেয়- কিন্তু আমাদের সময়ে সে ছেলে-ভোলাবার গল্প বলত, নানা অদ্ভুত সংস্কার জন্মিয়ে দিত, এবং চারি দিকের গাছপালা প্রকৃতির মুখশ্ৰী কোনো এক প্রাচীন বিধাতৃমাতার বৃহৎ রূপকথা-রচনারই মতো বোধ হত, নীতিকথা বা বিজ্ঞানপীঠ বলে ভ্ৰম হত না ।” “এই উপলক্ষে এখানে আর-একটি চিঠি উদধূত করিয়া দিব। এ চিঠি অনেকদিন পরে আমার ৩২ বছর বয়সে গোরাই নদী হইতে লেখা, কিন্তু দেখিতেছি সুর সেই একই রকমের আছে। এই চিঠিগুলিতে পত্ৰলেখকের অকৃত্ৰিম আত্মপরিচয়, অন্তত বিশেষ সময়ের বিশেষ মনের ভাব প্রকাশ পাইবে । ইহার মধ্যে যে-ভাবটুকু আছে তাহা পাঠকের পক্ষে যদি অহিতকর হয় তবে তাহারা সাবধান হইবেন— এখানে আমি শিক্ষকতা করিতেছি না। — ‘আমি প্রায় রোজই মনে করি, এই তারাময় আকাশের নীচে আবার কি কখনো জন্মগ্রহণ করব । যদি করি আর কি কখনো এমন প্ৰশান্ত সন্ধ্যাবেলায় এই নিস্তব্ধ গোরাই নদীটির উপরে বাংলাদেশের এই সুন্দর একটি কোণে এমন নিশ্চিন্ত মুগ্ধ মনে- পড়ে থাকতে পারব | হয়তো আর-কোেনা জন্মে এমন একটি সন্ধেবেলা আর কখনাে ফিরে পাব না। তখন কোথায় দৃশ্যপরিবর্তন হবে, আর কিরকম মন নিয়েই বা জন্মাব। এমন সন্ধ্যা হয়তো অনেক পেতেও পারি। কিন্তু সে-সন্ধ্যা এমন নিস্তব্ধভাবে তার সমস্ত কেশপাশ ছড়িয়ে দিয়ে আমার বুকের উপর এত সুগভীর ভালোবাসার সঙ্গে পড়ে থাকবে না - আশ্চর্য এই, আমার সব চেয়ে ভয় হয় পাছে আমি য়ুরোপে গিয়ে জন্মগ্রহণ করি। কেননা, সেখানে সমস্ত চিত্তটিকে এমন উপরের দিকে উদঘাটিত রেখে পড়ে থাকবার জো নেই, এবং পড়ে থাকাও সকলে ভারি দোষের মনে করে। হয়তো একটা কারখানায় নয়তো ব্যাঙ্কে নয়তো পার্লামেন্টে সমস্ত দেহ মন প্ৰাণ দিয়ে খাটতে হবে । শহরের রাস্তা যেমন ব্যাবসাবাণিজ্য গাডিঘোড়া চলাবার জন্যে ইটে-বাধানো কঠিন, তেমনি মনটা স্বভাবটা বিজনেস চালাবার উপযোগী পাকা করে বাধানো- তাতে একটি কোমল তৃণ, একটা অনাবশ্যক লতা গজাবার ছিদ্রটুকু নেই। ভারি ছাটাছোেটা গড়াপেটা আইনে-বাধা মজবুত রকমের ভাব। কী জানি, তার চেয়ে আমার এই কল্পনাপ্রিয় আত্মনিমগ্ন বিস্তৃত-আকাশ-পূর্ণ মনের ভাবটি কিছুমাত্র আগৌরবের বিষয় মনে হয় না।” “এখনকার কোনো কোনো নূতন মনস্তত্ত্ব পড়িলে আভাস পাওয়া যায় যে একটা মানুষের মধ্যে যেন অনেকগুলা মানুষ জটলা করিয়া বাস করে, তাহাদের স্বভাব সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। আমার মধ্যেকার যে অকেজো অদ্ভুত মানুষটা সুদীর্ঘকাল আমার উপরে কর্তৃত্ব করিয়া আসিয়াছে— যে-মানুষটা শিশুকালে বর্ষার মেঘ ঘনাইতে দেখিলে পশ্চিমের ও দক্ষিণের বারান্দাটায় অসংযত হইয়া ছুটিয়া বেড়াইত, যে-মানুষটা বরাবর ইস্কুল পালাইয়াছে, রাত্রি জাগিয়া ছাদে ঘুরিয়াছে, আজও বসন্তের হাওয়া বা শরতের রৌদ্র দেখা দিলে যাহার মনটা সমস্ত কাজকর্ম ফেলিয়া দিয়া পালাই-পালাই করিতে থাকে, তাহারই জবানি কথা এই ক্ষুদ্র জীবনচরিতের মধ্যে অনেক প্রকাশিত হইবে কিন্তু এ-কথাও বলিয়া রাখিব, আমার মধ্যে অন্য ব্যক্তিও আছে- যথাসময়ে তাহারও পরিচয় পাওয়া যাইবে ।” —প্রথম পাণ্ডুলিপি