পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্ৰন্থপরিচয় AS S উঠিয়াছে- কত বিচিত্র বর্ণ, কত বিচিত্র গন্ধ, কত বিচিত্র গান ! কাল যেন জগতে এত মহােৎসব ছিল না। অনেক দিনের পরে সহসা যেন সূর্যোদয় হইল। হৃদয়ও যখন আলো দিতে লাগিল সমস্ত জগৎও তাহার সৌন্দর্যচ্ছটা উদ্ভাসিত করিয়া দিল । সমস্ত জগতের সহিত হৃদয়ের এক অপূর্ব মিলন হইল। একজনের সহিত যখন আমাদের মিলন হয়, তখন সে মিলন আমরা কেবল তাঁহারই মধ্যে বদ্ধ করিয়া রাখিতে পারি না, অলক্ষ্যে অদৃশ্যে সে মিলন বিস্মৃত হইয়া জগতের মধ্যে গিয়া পৌঁছায়। সূচ্যগ্ৰ ভূমির জন্যও যখন আলো জ্বালা হয়, তখন সে আলো সমস্ত ঘরকে আলো না করিয়া থাকিতে পারে না । যে গেছে, সে সমস্ত জগৎ হইতে তাহার লাবণ্যচ্ছায়া তুলিয়া লইয়া গেছে।” যখন আমাদের প্রিয়বিয়োগ হয় তখন সমস্ত জগতের প্রতি আমাদের বিষম সন্দেহ উপস্থিত হয়, অথচ সন্দেহ করিবার কোনো কারণ দেখিতে পাই না বলিয়া হৃদয়ের মধ্যে কেমন আঘাত লাগে ; যেমন নিতান্ত কোনো অভূতপূর্ব ঘটনা দেখিলে আমাদের সহসা সন্দেহ হয় আমরা স্বপ্ন দেখিতেছি, আমাদের হাতের কাছে যে-জিনিস থাকে তাহা ভালো করিয়া স্পর্শ করিয়া দেখি এ-সমস্ত সত্য কিনা ; তেমনি আমাদের প্ৰিয়জন যখন চলিয়া যায়। তখন আমরা জগৎকে চারি দিকে সম্পর্শ করিয়া দেখি- ইহারাও সব ছায়া কিনা, মায়া কিনা, ইহারাও এখনই চারি দিক হইতে মিলাইয়া যাইবে কিনা । কিন্তু যখন দেখি ইহারা আচল রহিয়াছে তখন জগৎকে যেন তুলনায় আরো দ্বিগুণ কঠিন বলিয়া মনে হয় । দেখিতে পাই যে, তখন যে-ফুলেরা বলিত ‘সে না থাকিলে ফুটিব না, যে-জ্যোৎস্না বলিত ‘সে না থাকিলে উঠিব না, তাহারাও আজ ঠিক তেমনি করিয়াই ফুটিতেছে, তেমনি করিয়াই উঠিতেছে। তাহারা তখন যতখানি সত্য ছিল, এখনো ঠিক ততখানি সত্যই আছে— এক চুলও ইতস্তত হয় নাই – এইজন্য সে যে নাই, এই কথাটাই অত্যন্ত বেশি করিয়া মনে হয়, কারণ, সে ছাড়া আর-সমস্তই অতিশয় আছে। আমাকে যাহারা চেনে সকলেই তো আমার নাম ধরিয়া ডাকে, কিন্তু সকলেই কিছু একই ব্যক্তিকে ডাকে না, এবং সকলকেই কিছু একই ব্যক্তি সাড়া দেয় না । এক-একজনে আমার এক-একটা অংশকে ডাকে মাত্র, আমাকে তাহারা ততটুকু বলিয়াই জানে । এইজন্য আমরা যাহাকে ভালোবাসি তাহার একটা নূতন নামকরণ করিতে চাই ; কারণ, সকলের-সে ও আমার-সে। বিস্তর প্রভেদ । আমার যে গেছে সে আমাকে কতদিন হইতে জনিত— আমাকে কত প্ৰভাতে, কত দ্বিপ্রহরে, কত সন্ধ্যাবেলায় সে দেখিয়াছে ! কত বসন্তে, কত বর্ষায়, কত শরতে আমি তাহার কাছে ছিলাম ! সে আমাকে কত স্নেহ করিয়াছে, আমার সঙ্গে কত খেলা করিয়াছে, আমাকে কত শতসহস্র বিশেষ ঘটনার মধ্যে খুব কাছে থাকিয়া দেখিয়াছে ! যে আমাকে সে জানিত সে সেই সতেরো বৎসরের খেলাধুলা, সতেরো বৎসরের সুখ দুঃখ, সতেরো বৎসরের বসন্ত বর্ষা । সে আমাকে যখন ডাকিত তখন আমার এই ক্ষুদ্র জীবনের অধিকাংশই, আমার এই সতেরো বৎসর তাহার সমস্ত খেলাধুলা লইয়া তাহাকে সাড়া দিত। ইহাকে সে ছাড়া আর-কেহ জানিত না, জানে না । সে চলিয়া গেছে, এখন আর ইহাকে কেহ ডাকে না, এ আর-কাহারও ডাকে সাড়া দেয় না ! তাহার সেই বিশেষ কণ্ঠস্বর, তাহার সেই অতি পরিচিত সুমধুর স্নেহের আহবান ছাড়া জগতে এ আর-কিছুই চেনে না । বহির্জগতের সহিত এই ব্যক্তির আর-কেনো সম্বন্ধই রহিল না— সেখান হইতে এ একেবারেই পালাইয়া আসিল- এ-জন্মের মতো আমার হৃদয়-কবরের অতি গুপ্ত অন্ধকারের মধ্যে ইহার জীবিত সমাধি হইল । ৩৯ রবীন্দ্রভবনের পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া যায়।