পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

AS 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী আমি কেবল ভাবিতেছি, এমন তো আরো সতেরো বৎসর যাইতে পারে ! আবার তো কত নূতন ঘটনা ঘটবে, কিন্তু তাহার সহিত র্তাহার তো কোনো সম্পর্কই থাকিবে না ! কত নূতন সুখ আসিবে কিন্তু তাহার জন্য তিনি তো হাসিবেন না— কত নূতন দুঃখ আসিবে কিন্তু তাহার জন্য তিনি তো কাদিবেন না । কত শত দিনরাত্ৰি একে একে আসিবে কিন্তু তাহারা একেবারেই তিনি-হীন হইয়া আসিবে ! আমার সম্পৰ্কীয় যাহা-কিছু তাহার প্রতি তাহার বিশেষ স্নেহ আর-এক মুহুর্তের জন্যও পাইব না ! মনে হয়- তাহারও কত নূতন সুখ দুঃখ ঘটিবে, তাহার সহিত আমার কোনো যোগ নাই । যদি অনেক দিন পরে সহসা দেখা হয়, তখন তাহার নিকটে আমার অনেকটা অজানা, আমার নিকট তাহার অনেকটা অপরিচিত । অথচ আমরা উভয়েই নিতান্ত আপনার লোক । কোথায় নহবৎ বসিয়াছে ! সকাল হইতে না হইতেই বিবাহের বাশি বাজিয়া উঠিয়াছে । আগে বিছানা হইতে নূতন ঘুম ভাঙিয়া যখন এই বঁশি শুনিতে পাইতাম তখন জগৎকে কী উৎসবময় বলিয়া মনে হইত। বাঁশিতে কেবল আনন্দের কণ্ঠস্বরাটুকু মাত্র দূর হইতে শুনিতে পাইতাম, বাকিটুকু কী মোহময় আকারে কল্পনায় উদিত হইত ! কত সুখ, কত হাসি, কত হাস্যপরিহাস, কত মধুময় লজ্জা, আত্মীয়পরিজনের আনন্দ– আপনার লোকদের সঙ্গে কত সুখের সম্বন্ধে জড়িত হওয়া, ভালোবাসার লোকের মুখের দিকে চাওয়া, ছেলেদের কোলে করা, পরিহাসের লোকদের সহিত স্নেহময় মধুর পরিহাস করা, এমন কত কী দৃশ্য সূর্যালোকে চােখের সমুখে দেখিতাম ! এখন আর তাহা হয় না ! আজি ওই বাশি শুনিয়া প্ৰাণের এক জায়গা কোথায় হাহাকার করিতেছে। এখন কেবলই মনে হয়, বাঁশি বাজাইয়া যে-সকল উৎসব আরম্ভ হয় সে-সব উৎসবও কখন একদিন শেষ হইয়া যায় । তখন আর বঁাশি বাজে না ! বাপমায়ের যে স্নেহের ধনটি কঁাদিয়া অবশেষে কঠিন পৃথিবী হইতে নিশ্বাস ফেলিয়া চলিয়া যায়- একদিন সকালে মধুর সূর্যের আলোতে তাহার বিবাহেও বাঁশি বাজিয়াছিল। তখন সে ছেলেমানুষ ছিল, মনে কোনো দুঃখ ছিল না, কিছুই সে জানিত না ! বাঁশির গানের মধ্যে, হাসির মধ্যে, লোকজনের আনন্দের মধ্যে, চারি দিকে ফুলের মালা ও দীপের আলোর মধ্যে, সেই ছোটাে মেয়েটি গলায় হার পরিয়া, পায়ে দুগাছি মল পরিয়া বিরাজ করিতেছিল । অল্প বয়সে খুব বৃহৎ খেলা খেলিতে যেরূপ আনন্দ হয় তাহার সেইরূপ আনন্দ হইতেছিল । কে জানিত সে কী খেলা খেলিতে আরম্ভ করিল ! সেদিনও প্রভাত এমনি মধুর ছিল ! দেখিতে দেখিতে কত লোক তাহার নিতান্ত আত্মীয় হইল, তাহার প্রাণের খুব কাছাকাছি বাস করিতে লাগিল, পরের সুখ দুঃখ লইয়া সে নিজের সুখ দুঃখ রচনা করিতে লাগিল । সে তাহার কোমল হৃদয়খানি লইয়া দুঃখের সময় সান্তুনা করিত, কোমল হাত দুখানি লইয়া রোগের সময় সেবা করিত । সেদিন বঁাশি বাজাইয়া আসিল, সে আজ গোল কী করিয়া ! সে কেন চোখের জল ফেলিল ! সে তাহার গভীর হৃদয়ের অতৃপ্তি, তাহার আজন্মকালের দুরাশা, শ্মশানের চিতার মধ্যে বিসর্জন দিয়া গেল কোথায় ! সে কেন বালিকাই রহিল না, তাহার ভাইবোনদের সঙ্গে চিরদিন খেলা করিল না ! সে আপনার সাধের জিনিস সকল ফেলিয়া আপনার ঘর ছাড়িয়া, আপনার বড়ো ভালোবাসার লোকদের প্রতি একবার ফিরিয়া না চাহিয়া- যে-কোলে ছেলেরা খেলা করিত, যে-হাতে সে রোগীর সেবা করিত, সেই স্নেহমাখানো কোল, সেই কোমল হাত, সেই সুন্দর দেহ সত্য সত্যই একেবারে ছাই করিয়া চলিয়া গেল ! কিন্তু সেদিনকার সকালবেলার মধুর বঁাশি কি এত কথা বলিয়াছিল! এমন রোজই কোনাে-না কোনো জায়গায় বঁাশি তো বাজিতেছেই । কিন্তু এই বঁাশি বাজাইয়া কত হৃদয় দলনি হইতেছে, কত জীবন মরুভূমি হইয়া যাইতেছে, কত কোমল হৃদয় আমরণকাল অসহায়ভাবে প্রতিদিন প্রতি মুহুর্তে নূতন নূতন আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হইয়া যাইতেছে- অথচ একটি কথা বলিতেছে না,