পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ومالا ۹ জগৎ-সমুদ্রের মাঝখানে নিজের নীেকাডুবি করিয়া আর কুলকিনারা দেখিতে চায় না। তাহার খানিকটা গিয়াছে বলিয়া সে আর বাকি কিছুই রাখিতে চায় না । সে বলে, তাহার সঙ্গে সমস্তটাই যাক । কিন্তু সমস্তটা তো যায় না, আমরা নিজেই বাকি থাকি যে ! তাই যদি হইল। তবে কেন । আমরা সহসা আপনাকে উন্মাদের মতো নিরাশ্রয় করিয়া ফেলি । হৃদয়ের এই অন্ধকারের সময় আশ্রয়কে আরো বেশি করিয়া ধরি না কেন । এ-সময়ে মনে করি না কেন, বিশ্বের নিয়ম কখনোই এত ভয়ানক ও এত নিষ্ঠুর হইতেই পারে না। সে আমাকে একেবারেই ডুবাইবে না, আমাকে আশ্রয় দিবেই ! যেখানেই হউক এক জায়গায় কিনারা আছেই, তা সে সমুদ্রের তলেই হউক আর সমুদ্রের পারেই হউক।- মরিয়াই হউক আর বঁাচিয়াই হউক । মিছামিছি। আর তো ভাবা যায় কাজ করাইয়া লইতেছে। কাজ হইয়া গেলেই সে আমাদিগকে গলাধাক্কা দিয়া দূর করিয়া দেয়। কিন্তু এত বড়ো যাহার কারখানা, যাহার রাজ্যে এমন বিশাল মহত্ত্ব বিরাজ করিতেছে, সে কি সত্য সত্যই এই কোটি কোটি অসহায় জীবকে একেবারেই ফাকি দিতে পারে ! সে কি এই-সমস্ত সংসারের তাপে তাপিত, অহৰ্নিশি কার্যতৎপর, দুঃখে ভাবনায় ভারাক্রান্ত, দীনহীন গলদঘর্ম প্রাণীদিগকে মেকি টাকায় মাহিয়ানা দিয়া কাজ করাইয়া লইতেছে! সে টাকা কি কোথাও ভাঙাইতে পারা যাইবে না ! এখানে না-হয় আর-কোথাও ? এমন ঘোরতর নিষ্ঠুরতা ও হীন প্ৰবঞ্চনা কি এত বড়ো মহত্ত্ব ও এত বড়ো স্থায়িত্বের সহিত মিশ খায় ! কেবলমাত্র ফকির জাল গাথিয়া গাথিয়া কি এমনতরো অসীম ব্যাপার নির্মিত হইতে পারিত । কেবলমাত্ৰ আশ্বাসে আজন্মকাল কাজ করিয়া যদি অবশেষে হৃদয়ের শীতবস্ত্রটুকুও পৃথিবীতে ফেলিয়া পুরস্কারস্বরূপ কেবলমাত্র অতৃপ্তি ও অশ্রািজল লইয়া সকলকেই মরণের মহামেরুর মধ্যে নির্বাসিত হইতে হয়, তবে এই অভিশপ্ত রাক্ষস সংসার নিজের পাপসাগরে নিজে কোন কালে ডুবিয়া মরিত । কারণ, প্রকৃতির মধ্যেই ঋণ এবং পরিশোধের নিয়মের কোথাও ব্যতিক্রম নাই। কেহই এক কড়ার ঋণ রাখিয়া যাইতে পারে না, তাহার সুন্দসুদ্ধ শুধিয়া যাইতে হয়- এমন-কি, পিতার ঋণ পিতামহের ঋণ পর্যন্ত শুধিতে সমস্ত জীবন যাপন করিতে হয়। এমন স্থলে প্রকৃতি যে চিরকাল ধরিয়া অসংখ্য জীবের দেনাদার হইয়া থাকিবে এমন সম্ভব বোধ হয় না, তাহা হইলে সে নিজের নিয়মেই নিজে মারা পড়িত । তুমি যে-ঘরটিতে রোজ সকালে বসিতে তাঁহারই দ্বারে স্বহস্তে যে-রজনীগন্ধার গাছ রোপণ করিয়াছিলে তাহাকে কি আর তোমার মনে আছে! তুমি যখন ছিলে তখন তাহাতে এত ফুল ফুটিত না, আজ সে কত ফুল ফুটাইয়া প্রতিদিন প্রভাতে তোমার সেই শূন্য ঘরের দিকে চাহিয়া থাকে। সে যেন মনে করে, বুঝি তাহারই পরে অভিমান করিয়া তুমি কোথায় চলিয়া গিয়াছ ! তাই সে আজ বেশি করিয়া ফুল ফুটাইতেছে। তোমাকে বলিতেছে, “তুমি এসো, তোমাকে রোজ ফুল দিব !” হায় হায়, যখন সে দেখিতে চায় তখন সে ভালো করিয়া দেখিতে পায় নাআর যখন সে শূন্যহৃদয়ে চলিয়া যায়, এ-জন্মের মতো দেখা ফুরাইয়া যায়, তখন আর তাহাকে ডাকিতে থাকে । আমিও তোমার গৃহের শূন্য দ্বারে বসিয়া প্রতিদিন সকালে একটি একটি করিয়া রজনীগন্ধা ফুটাইতেছি- কে দেখিবে ! ঝরিয়া পড়িবার সময় কাহার সদয় চরণের তলে ঝরিয়া পড়িবে !! আর-সকলেই ইচ্ছা করিলে এই ফুল ছিড়িয়া লইয়া মালা গাঁথিতে পারে, ফেলিয়া দিতে পারে- কেবল তোমারই স্নেহের দৃষ্টি এক মুহুর্তের জন্যও ইহাদের উপরে আর পড়িবে না!** ৪১ পাণ্ডুলিপিতে ইহার পর একটি গান আছে- ‘কেহ কারো মন বুঝে না ইত্যাদি। গীতবিতান দ্রষ্টব্য