পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१२७ A. রবীন্দ্র-রচনাবলী বিশিষ্টতার মধ্যে ঐক্য উপলব্ধি করার সাধনা সর্বজনীনতা- নতুবা তাহার কোনো প্রয়োজন নাই। বিশিষ্টতাকে স্বীকার করা যে কুসংস্কার এইরূপ সৃষ্টিছাড়া কথাই অন্ধ সংস্কার । অতএব হিন্দুত্বের সংকীর্ণ গভী কাটাইয়া যাওয়াকে উন্নতিশীলতা বা কোনো শীলতাই বলে না, তাহা একটা ব্যর্থবাক্য ; উচ্চারণ মাত্র । ভূতের বিশ্বাস পৃথিবীতে সকল জাতির মধ্যেই ন্যূনাধিক পরিমাণে আছে— যখন বলা যায় আমি এই ভূতের বিশ্বাসের কুসংস্কার কাটাইয়াছি তখন এমন কথা বলা হয় না যে আমি মনুষ্যত্বের সংকীর্ণ গণ্ডী অতিক্ৰম করিয়াছি। তেমনি হিন্দুসমাজে যে কুসংস্কার প্রচলিত আছে যদি কোনো হিন্দু সে সংস্কার কাটাইয়া থাকেন তবে তীহাকে কুসংস্কারহীন হিন্দু বলিব, অহিন্দু বলিব না। কুসংস্কারই হিন্দুর স্থায়ী পরিচয় এমন অদ্ভুত কথা কোনােমতেই বলা চলে না। এ কথা আমাদিগকে স্বীকার করিতেই হইবে, অন্ধসংস্কার মানুষের সকল জাতির মধ্যেই আছে কিন্তু বিধাতার রাজ্যে অন্ধসংস্কারের স্বভাবই এই যে তাহা নিত্য নহে ; বস্তুত এইজন্যই উন্নতিশীল হওয়া সম্ভব, এবং এইজন্যই আদি ব্ৰাহ্মসমাজের অথবা অন্য যে-কোনো সম্প্রদায়ের মানুষ যতই মূঢ় ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন হই-না তৎসত্ত্বেও আমরা উন্নতিশীল, কারণ, আমরাও মানুষ । তাই যদি না হইবে তবে পৃথিবীতে ধর্মসংস্কারকের মতো উন্মত্ত পাগল আর তো কেহই নাই | সত্যমেব জয়তে এই বাণী ছাড়িয়াছেন- অসাধারণ উন্নতিলাভ করিলেও এমন কথা বলিতে পারিব না । অতএব হিন্দুসমাজের প্রচলিত ভ্রম ও অন্ধসংস্কার বর্জন করার দ্বারাই যদি আমরা অহিন্দু হই তবে শিশু রাম কথা কহিতে শিখিলেই শ্যাম হইয়া যায়। এ কথাটা বলা চলে। তাহাকে বালক রাম বা যুবক রাম বা সুবুদ্ধি রাম বল তাহাতে কোনো বাধা নাই। কিন্তু তাহাকে রামই বলিব না। এমন পণ করিলে মানুষের নিত্যই নূতন নামকরণ করিয়া চলিতে হয় । এই যে, “তুমি আমাকে হিন্দু বলিতেছ। তবেই তো বলা হইতেছে আমি পৌত্তলিক, আমি জাতিভেদ মানি ইত্যাদি ইত্যাদি ; তুমি নিজের সম্বন্ধে এমন কথা বলিতে পারো, কেননা, তুমি কুসংস্কারপন্ন, তুমি সাধারণ বা নববিধান ব্ৰাহ্মসমাজের নও, তোমার পিতা এমন কাজ করিয়াছেন, তিনি এমন কথা বলিয়াছেন ইত্যাদি ইত্যাদি ।” বস্তুত আমার পিতা যদি অত্যন্ত সংকীর্ণ সংস্কারের অনুদার প্রকৃতির লোক ছিলেন ইহাই প্রকৃত সত্য হয় তবে আমার পিতাকে আমি তো পিতারূপে ত্যাগ করিতে পারিব না। যদিও বা আমার কোনো-একটা অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় তাহা আমার ইচ্ছার মধ্যেও উদয় হয় তথাপি তাহা আমার সাধ্যের মধ্যে নাই । আমারই পিতার সন্তান যে আমি, এ গণ্ডী বিধাতার গণ্ডী । সুখের বিষয় এই যে, এই গণ্ডী স্বীকার করিয়াও আমি সর্বজনীন হইতে পারি, এমন-কি, কোনো একদিন হঠাৎ কায়ক্লেশে উন্নতিশীল হইয়া উঠাও আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব নহে। হিন্দুত্বের গণ্ডীর মধ্যেও বিধাতার সেই বিধান আছে বলিয়াই তাহা নানা পরিণতির মধ্য দিয়া অগ্রসর হইয়াছে এবং এখনো হইবে।— হিন্দুসমাজের মধ্যেও সেই সত্যস্বরূপ বিধাতার বিধান কাজ করে বলিয়াই এই সমাজেই আজ আমরা রামমোহন রায়ের অভ্যুদয় দেখিলাম। ইহাতেও কি বিধাতার উপরে বিশ্বাস জন্মে না, সত্য বিধানের প্রতি নির্ভর বাড়ে না ? হিন্দুসমাজে ভ্ৰম আছে, অন্ধসংস্কার আছে, সবই আছে মানি কিন্তু তাহার চেয়ে বেশি করিয়া মানি হিন্দুসমাজেও সত্য আছেন, মঙ্গল আছেন, ব্ৰহ্ম আছেন । হিন্দুসমাজের মধ্যে আমি সেই সত্যের দিকে মঙ্গলের দিকে ব্ৰহ্মের দিকে দাড়াইব ইহাই যেন আমার সংকল্প হয় । সাধক র্যাহারা তাহারা সকল সমাজেই সত্যের দিকেই নিজের জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া তাহারই অভিমুখে সকলের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করেন । যেখানে অসত্যের অজ্ঞানের প্রভাব বেশি সেইখানেই সত্যকে তাহারা দেখেন ও