পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্ৰন্থপরিচয় ৭২৯ - সম্পাদক মহাশয় বলিয়াছেন, সব ধর্মই যদি হিন্দুধর্ম হইতে পারে, যদি হিন্দুর বিশেষ ধর্ম কী তাহা আমরা না জানি তবে তো নিজেকে হিন্দু বলাও যা আর সাদা চেকে স্বাক্ষর করাও তা ।** সকল জাতির মধ্যেই তো সাদা চেকের ফাঁকা জায়গা আছে। কোনো ইংরেজ যদি এরূপ মত। প্রকাশ করে যে, জাতিভেদ ভালো অথবা জেনেনা প্রথা স্ত্রীপ্রকৃতির পক্ষে যথার্থ অনুকূল তথাপি যে ইংরেজ ইংরেজ তাহার সকল বিষয়ে সকল মতই একেবারে অবিচলিত রূপে পাকা করিয়া স্থির হইয়া বসিয়াছে বলিয়াই প্রত্যেক ইংরেজ আপনাকে ইংরেজ বলিবার অধিকার পাইয়াছে ইহাই কি সত্য ? প্রত্যেক ইংরেজের হাতেই সাদা চেকের খাতা আছে তাহাতে তাহার। আপনাকে ইংরেজ বলিবার কোনাে বাধা ঘটে নাই। সেইরূপ আমরা দেখাইয়াছি হিন্দু কোনো বিশেষ নির্দিষ্ট ধর্মের বা মতের পরিচায়ক নহে। কিন্তু সেইজন্যই যদি হিন্দু বলিয়া কিছুই না থাকে। তবে মানুষ বলিয়াও কিছু থাকে না, তবে কেহ বলিয়াও কেহ নাই। আমি যে একজন বিশেষনামধারী ব্যক্তি, আমার ব্যক্তিত্ব আশ্রয় করিয়া অসংখ্য পরিবর্তন প্রবাহিত হইয়া চলিয়াছে, ছেলেবেলা হইতে আজ পর্যন্ত আমি কত ভুল বুঝিয়াছি ও সে ভুল ছাড়িয়াছি, কত মত লইয়াছি ও বিসর্জন দিয়াছি, শিক্ষক মহাশয়ের দ্বারা কাটাকুটি-করা আমার রাশি রাশি এক্সেসাইজ বহির সঙ্গে আর আমার আদ্যকার শিক্ষার একেবারে আকাশ-পাতাল প্রভেদ, আশৈশবকাল হইতে আজ পর্যন্ত নিজের সমস্ত খুঁটিনাটি যদি বিচার করিয়া দেখি তো দেখিব, মতে ভাবে কর্মে আত্মবিরোধের আর অন্ত নাই। কিন্তু তৎসত্ত্বেও সেই সমস্ত বিরোধ ও অনৈক্যগুলিও একটি গভীরতম ঐক্যসূত্রে গ্রথিত হইয়াছে ; সেই সূত্রটি আচ্ছন্ন, তাহাকে প্রত্যক্ষ করিয়া নির্দেশ করা কঠিন : অনৈক্যের পরম্পরাটাই বাহিরে প্রকাশমান- তবু যে লোক দেখিতেছে সে এই অনৈক্যের মালাকেও মালা বলিয়া দেখিতেছে- সে প্রতিদিনের ভূরি ভুরি বিচ্ছেদের মধ্যেও আমাকে বিচ্ছিন্ন পদাৰ্থ বলিয়া ভ্ৰম করিতেছে না । অতএব, যেমন সকল জাতিরই, যেমন সকল মানুষেরাই, তেমনি হিন্দুরও ইতিহাসে মতের ধর্মের আচারের পরিবর্তনহীন অবিচলিত ঐক্য নাই, সেরূপ ঐক্য থাকিতে পারে না, এবং না থাকাই মঙ্গল । সেইরূপ নিশ্চল ঐক্য আছে বলিয়া র্যাহারা গৌরব বোধ করেন তাহদের সেই গৌরববোধ কাল্পনিক- সেরাপ ঐক্য নাই বলিয়া যদি কেহ অবজ্ঞা প্রকাশ করেন তবে তাহদের সেই অবজ্ঞাও একেবারে অযৌক্তিক । ভারতবর্ষে হিন্দুজাতির সহস্র বিচ্ছিন্নতার মাঝখানে যে এক প্রবল শক্তি গভীর ভাবে কাজ করিতেছে সেই শক্তি আর্যের সঙ্গে অনার্যকে রক্তে রক্তে মিলাইয়া দিয়াছে, সেই শক্তি শক জুন এবং গ্রীক উপনিবেশগুলিকে আত্মসাৎ করিয়া ফেলিয়াছে, সেই শক্তি শত শত ধর্মমত ও আচারকে আপনার মধ্যে স্থান দিয়াছে এবং সেই শক্তিই সকল ধর্মের অনৈক্যের ভিতর দিয়া অনন্ত সত্যের একটি সুমহৎ ঐক্যকে উপলব্ধি করিবার সাধনায় প্রবৃত্ত হইয়াছে। তাহার কার্যক্ষেত্র অতি বৃহৎ, তাহার উপকরণ অতি বিপুল বলিয়াই তাহার বাধাও পর্বতপ্রমাণ— কিন্তু এই বাধাই তাহার নিত্য নহে ; সে মহত্তম সত্যকে চায় বলিয়াই গুরুতর ভ্ৰান্তির সহিত পদে পদে তাহাকে লড়াই করিতে হইতেছে ; সে যে সামঞ্জস্যকে ঘটাইয়া তুলিবার দায়িত্ব নিজের স্কন্ধে লইয়াছে তাহা সংকীর্ণ নহে বলিয়াই তাহার অনৈক্যভারে সুদীর্ঘ পথ সে এমন পীড়িত হইয়া চলিয়াছে কিন্তু তৎসত্ত্বেও এই অনৈক্যরাশিই তাহার চরম সঞ্চয় নহে । আজ যদি এই হিন্দুর ইতিহাসের সমস্ত শিক্ষার ভিতর দিয়া আমরা কোনো একটি ঐক্যের উপলব্ধিকে পাইয়া থাকি তবে অকৃতজ্ঞের মতো কি আমরা এমন কথা বলিতে পারি যে, সাধনা যাহার সিদ্ধি তাহার নহে ? এতদিনের দায়-বহনটা রহিল হিন্দুর, আর সই দায়-শোধের অঙ্কটা কেবলমাত্র আমাদের সাম্প্রদায়িক ক্ষুদ্র খাতায় জমা করিয়া লইব এবং তাঁহাকেই নাম দিব অসাম্প্রদায়িকতা ? যেখানেই হিন্দু-ইতিহাসের সফলতা সেইখানেই আমি তাড়াতাড়ি সকলকে ঠেলিয়া-তুলিয়া সকল ৪৯ সাদা কাগজে স্বাক্ষর, তত্ত্বকীেমুদী, ১ বৈশাখ ১৩১৯