পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

85 o রবীন্দ্র-রচনাবলী নিরুপমা সমস্ত ব্যাপার বুঝিতে পারিয়া কহিল, "বাবা, তুমি যদি আর এক পয়ল আমার শ্বশুরকে দাও, তা-হলে আর তোমার মেয়েকে দেখতে পাবে না, এই তোমার গা ছয়ে বললুম।” রামস্বন্দর বলিলেন, “ছি মা, অমন কথা বলতে নেই। আর এটাকাটা যদি আমি না দিতে পারি, তা-হলে তোর বাপের অপমান। আর তোরো অপমান।” নিরু কহিল, “টাকা যদি দাও তবেই অপমান । তোমার মেয়ের কি কোনো মর্যাদা নেই। আমি কি কেবল একটা টাকার থলি, যতক্ষণ টাকা আছে ততক্ষণ আমার দাম । না বাবা, এ-টাকা দিয়ে তুমি আমাকে অপমান কোরে না। তা ছাড়া আমার স্বামী তো এ-টাকা চান না ।” রামসুন্দর কহিলেন, “তা-হলে তোমাকে যেতে দেবে না, মা ।” নিরুপমা কহিল, “না দেয় তো কী করবে বলে । তুমিও আর নিয়ে যেতে চেয়ে না ।” রামসুন্দর কম্পিত হস্তে নোটবাধা চাদরটি কাধে তুলিয়া আবার চোরের মতো সকলের দৃষ্টি এড়াইয়া বাড়ি ফিরিয়া গেলেন। কিন্তু রামসুন্দর এই-যে টাকা আনিয়াছিলেন এবং কন্যার নিষেধে সে টাকা না দিয়াই চলিয়া গিয়াছেন, সে-কথা গোপন রহিল না। কোনো স্বভাবকৌতুহলী স্বারলগ্নকৰ্ণ দাসী নিরুর শাশুড়ীকে এই খবর দিল । শুনিয়া তাহার আর আক্রোশের সীমা রহিল না । নিরুপমার পক্ষে তাহার শ্বশুরবাড়ি শরশয্যা হইয়া উঠিল । এদিকে তাহার স্বামী বিবাহের অল্পদিন পরেই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হইয়। দেশান্তরে চলিয়া গিয়াছে ; এবং পাছে সংসৰ্গদোষে হীনতা শিক্ষা হয়, এই ওজরে সম্প্রতি বাপের বাড়ির আত্মীয়দের সহিত নিরুর সাক্ষাৎকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হইয়াছে । এই সময়ে নিরুর একটা গুরুতর পীড়া হইল। কিন্তু সেজন্য তাহার শাশুড়ীকে সম্পূর্ণ দোষ দেওয়া যায় না। শরীরের প্রতি সে অত্যন্ত অবহেলা করিত। কার্তিকমাসের হিমের সময় সমস্তরাত মাথার দরজা খোলা, শীতের সময় গায়ে কাপড় নাই । আহারের নিয়ম নাই। দাসীরা যখন মাঝে-মাঝে খাবার আনিতে ভুলিয়া যাইত, তখন যে তাহদের একবার মুখ খুলিয়া স্মরণ করাইয়া দেওয়া, তাহাও সে করিত না। সে-ষে পরের ঘরের দাসদাসী এবং কর্তাগৃহিণীদের অনুগ্রহের উপর নির্ভর করিয়া বাস করিতেছে, এই সংস্কার তাহার মনে বদ্ধমূল হইতেছিল। কিন্তু এরূপ ভাবটাও শাশুড়ীর সহ হইত না। যদি আহারের প্রতি বধূর কোনো অবহেলা দেখিতেন,