পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ 8२({ আসিয়া জুড়িয়া বসিবে, ইহা কোন সংকুলপ্রদীপ কনকচন্দ্র সন্তান সহ করিতে পারে। যদি-বা মরণকালে এবং ডাকিনীর মন্ত্রগুণে কোনো-এক মুঢ়মতি জ্যেষ্ঠতাতের বুদ্ধিভ্রম হইয়া থাকে, তবে স্ববর্ণময় ভ্রাতুষ্পুত্র সে-ভ্রম নিজহস্তে সংশোধন করিয়া লইলে এমন কী অন্যায় কার্য হয় । । হতবুদ্ধি রামকানাই যখন দেখিলেন, তাহার স্ত্রী পুত্র উভয়ে মিলিয়া কখনো-ব তর্জনগর্জন কখনো-বা অশ্রুবিসর্জন করিতে লাগিলেন, তখন ললাটে করাঘাত করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন – আহার ত্যাগ করিলেন, জল পর্যন্ত স্পর্শ করিলেন না। এইরূপে দুই দিন নীরবে অনাহারে কাটিয়া গেল, মকদ্দমার দিন উপস্থিত হইল। ইতিমধ্যে নবদ্বীপ বরদাসুন্দরীর মামাতো ভাইটিকে ভয় প্রলোভন দেখাইয়া এমনি বশ করিয়া লইয়াছে যে, সে অনায়াসে নবদ্বীপের পক্ষে সাক্ষ্য দিল । জয়শ্রী যখন বরদাসুন্দরীকে ত্যাগ করিয়া অন্য পক্ষে যাইবার আয়োজন করিতেছে, তখন রামকানাইকে ডাক পড়িল । অনাহারে মৃতপ্রায় শুষ্কওষ্ঠ শুষ্করসন বৃদ্ধ কম্পিত শীর্ণ অঙ্গুলি দিয়া সাক্ষ্যমঞ্চের কাঠগড়া চাপিয়া ধরিলেন। চতুর ব্যারিস্টার অত্যন্ত কৌশলে কথা বাহির করিয়া লইবার জন্য জেরা করিতে আরম্ভ করিলেন,— বহুদূর হইতে আরম্ভ করিয়া সাবধানে অতি ধীর বক্রগতিতে প্রসঙ্গের নিকটবতী হইবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন । তখন রামকানাই জজের দিকে ফিরিয়া জোড়হস্তে কহিলেন, “হুজুর, আমি বৃদ্ধ, অত্যন্ত দুর্বল। অধিক কথা কহিবার সামর্থ্য নাই। আমার যা বলিবার সংক্ষেপে বলিয়া লই। আমার দাদা স্বৰ্গীয় গুরুচরণ চক্রবর্তী মৃত্যুকালে সমস্ত বিষয়সম্পত্তি র্তাহার পত্নী শ্ৰীমতী বরদাসুন্দরীকে উইল করিয়া দিয়া যান। সে-উইল আমি নিজহস্তে লিখিয়াছি এবং দাদা নিজহস্তে স্বাক্ষর করিয়াছেন। আমার পুত্র নবদ্বীপচন্দ্র যে-উইল দাখিল করিয়াছেন তাহা মিথ্যা।” এই বলিয়া রামকানাই কঁাপিতে কঁাপিতে মুছিত হইয়া পড়িলেন। চতুর ব্যারিস্টার সকৌতুকে পাশ্ববতী অ্যাটর্নিকে বলিলেন, “বাই জোভ । লোকটাকে কেমন ঠেসে ধরেছিলুম।” মামাতো ভাই ছুটিয়া গিয়া দিদিকে বলিল, “বুড়ে সমস্ত মাটি করিয়াছিল,— আমার সাক্ষ্যে মকদমা রক্ষা পায় ।” দিদি বলিলেন, “বটে ? লোক কে চিনতে পারে। আমি বুড়োকে ভালো বলে জানতুম।”