পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SS 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী চেষ্টা— যাহাতে যথাসম্ভব স্বাধীনতা পায়। কিন্তু মনুয্যের পক্ষে পূর্ণ স্বাধীনতা পাওয়া অসম্ভব। পৃথিবীতে যথাসম্ভব স্বাধীনতা পাইতে গেলেই নিজেকে অধীন করিতে হয়। দুর্বলপদ বৃদ্ধ স্বাধীন ভাবে বিচরণ করিতে ইচ্ছা করিলে যষ্টির অধীনতা স্বীকার করেন। তেমনি রাজার (Government) অধীনে না থাকিলে প্ৰজার স্বাধীনতা রক্ষা হয় না, আবার প্রজার অধীনে না থাকিলে রাজাও অধিক দিন স্বাধীনতা রাখিতে পারেন না। আমরা যথাসম্ভব স্বাধীন হইবার অভিপ্ৰায়ে সমাজের শত সহস্র নিয়মের অধীনতা স্বীকার করি ; যে ব্যক্তি সমাজের প্রত্যেক নিয়ম দাসভাবে পালন করে, আমরা তাহাকে প্ৰশংসা করি; যে তাহার একটি নিয়ম উচ্ছেদ করে, আমরা তাহাকে উচ্ছেদ করিবার জন্য বন্ধপরিকর হই। এইরূপে অধীনতাকে আমরা পূজা করি। এবং সাধারণ লোকে মনে করে যে- অধীনতা পূজনীয় কেননা সে অধীনতা; রাজার প্রতি অন্ধনির্ভর পূজনীয়, কেননা তাহ রাজভক্তি; সমাজের নিয়ম-পালন পূজনীয়, কেননা তাহা সমাজের নিয়ম। কিন্তু তাহা তো নয়। অসম্পূৰ্ণ পৃথিবীতে অধীনতা স্বাধীনতার সোপান বলিয়াই তাহার যা গৌরব। সে কার্যের যখনই সে অনুপযোগী ও প্রতিরোধী হইবে তখনই তাহাকে পদাঘাতে ভাঙিয়া ফেলা উচিত ; আমাদের এমনি কপাল, যে, কণ্টক বিধাইয়া কণ্টককে উদ্ধার করিতে হয়, কিন্তু তাই বলিয়া উদ্ধার হইয়া গেলেও যে অপর কণ্টকটিকে কৃতজ্ঞতার সহিত ক্ষতস্থানে বিধাইয়া রাখিতে হইবে, এমন কোনো কথা নাই। যখন স্বাধীনতা রক্ষার জন্য রাজ্য-শাসনের আবশ্যক থাকিবে না। বরঞ্চ বিপরীত হইবে, তখন রাজাকে দূর করো, রাজভক্তি বিসর্জন করো। যখন সমাজের কোনো নিয়ম আমাদের স্বাধীনতা-রক্ষার সাহায্য না করিবে, তখন নিয়মরক্ষার জন্য যে সে নিয়ম রক্ষা করিতে হইবে তাহা নহে। তাহা যদি করিতে হয়, তবে এক অধীনতার হস্ত হইতে ‘দ্বিতীয় অধীনতার হস্তে পড়িতে হয় ; অসহায় সাক্সনেরা যেমন শত্রু অত্যাচার হইতে রক্ষা পাইবার জন্য প্ৰবলতর শক্রকে আহবান করিয়াছিল- স্বাধীনতা পাইবার জন্য, অস্তিত্ব প্ৰবল করিবার জন্য, স্বাধীনতা ও অস্তিত্ব উভয়ই বিসর্জন দিয়াছিল- সমাজেরও ঠিক তাহাই হয় । ইহাই সংস্কারের গোড়ার কথা । এক দল লোক বিলাপ করিবেই। বোধ করি এমন কাল কোনো কালে ছিল না, যখন এক দল লোক স্মৃতি-বিস্মৃতি-বিজড়িত কুহেলিকাময় অতীত কালের জন্য দীর্ঘ নিশ্বাস না ফেলিয়াছে ও বর্তমান কালের মধ্যে সর্বনাশের, প্ৰলয়ের বীজ না দেখিয়াছে। সত্যযুগ কোনো কালে বর্তমান ছিল না, চিরকাল অতীত ছিল। তৃতীয় নেপোলিয়নকে জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিল, “আপনি কী হইতে ইচ্ছা করেন?' তিনি উত্তর করিয়াছিলেন, “আমি আমার পৌত্র হইতে ইচ্ছা করি!” ভবিষ্যৎ তাহার চক্ষে এমন লোভনীয় বলিয়া ঠেকিয়াছিল! কিন্তু কত শত সহস্ৰ লোক আছেন, তাহদের উক্ত প্রশ্ন করিলে উত্তর করেন, “আমি আমার পিতামহ হইতে ইচ্ছা করি!” ইহাদের পৌত্রেরাও আবার ঠিক তাহাই ইচ্ছা করিবে । এক দল লোক আছেন, তাহারা পরিবর্তন মাত্রেরই বিরোধী নহেন। তাহারা আংশিক পরিবর্তন করিতে চাহেন। তাহদের বিষয় লেখাই বর্তমান প্ৰবন্ধের উদ্দেশ্য। তাহারা বলেন, বিধবাবিবাহে আমাদের মত নাই; তবে সংস্কার করিতে হয় তো বিধবাদের অবস্থা-সংস্কার কারো- তাহদের উপবাস করিতে না হয়, তাহদের মৎস্য মাংস খাইতে নিষেধ না থাকে, বেশবিন্যাস বিষয়ে তাহদের ইচ্ছাকে অন্যায় বাধা না দেওয়া হয়। এক কথায়, বিধবাদের প্রতি সমাজের যত প্রকার অত্যাচার আছে তাহা দূর হউক, কিন্তু তাহাঁই বলিয়া বিধবারা সধবা হইতে পরিবে না। তাহারা বলিবেন,- “অসবর্ণ বিবাহ! কী সর্বনাশ! কিন্তু অনুরাগমূলক বিবাহে আমাদের আপত্তি নাই। পিতামাতাদের দ্বারা বধু নির্বাচিত না হইয়া প্ৰণয়াকৃষ্ট বিবাহেছুক যদি স্বয়ং আপনার উপযোগী পাস্ত্রী স্থির করে তো ভালো হয়। কিন্তু অসবর্ণ বিবাহ নৈব নৈবচ।” তাহারা পুত্রের বয়স অধিক না হইলে বিবাহ দিতে অনুমতি করেন না, কিন্তু কন্যাকে অল্প বয়সে বিবাহ দেন। তাহারা শ্ৰীশিক্ষার আবশ্যকতা বুঝিয়াছেন। কিন্তু স্ত্রী-স্বাধীনতাকে ডরান। লোকাচারিবিশেষের উপর তাহদের বিরাগ নাই, তাহার আনুষঙ্গিক দুই-একটা অনুষ্ঠানের প্রতি তাহদের আক্রোশ। তাহারা বুঝেন না যে, সেই অনুষ্ঠানগুলি সেই লোকাচারের অন্তত। তাহারা যাহা