পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SS br রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী অনুরোধে কোথাও কিছু সংকীর্ণ করিয়া লও, তবে নিশ্চয়ই তুরায় হউক আর বিলম্বেই হউক, তাহার বিশুদ্ধতা সম্পূৰ্ণ নষ্ট হইয়া যাইবে। সে আর তোমাকে বল ও স্বাস্থ্য দিতে পরিবে না। শুদ্ধ সত্যকে যদি বিকৃত সত্য,সংকীর্ণ সত্য,আপাতত সুবিধার সত্য করিয়া তোল তবে উত্তরোত্তর নষ্ট হইয়া সে মিথ্যায় পরিণত হইবে, কোথাও তাহার পরিত্রাণ নাই। কারণ, অসীমের উপর সত্য দাড়াইয়া আছে, আমারই উপর নহে, তোমারই উপর নহে, অবস্থাবিশেষের উপর নহে- সেই সত্যকে সীমার উপর দাড় করাইলে তাহার প্রতিষ্ঠাভূমি ভাঙিয়া যায়- তখন বিসৰ্জিত দেবপ্রতিমার তৃণকাষ্ঠের ন্যায় তাহাকে লইয়া যে-সে যথেচ্ছ টানা-ছেড়া করিতে পারে সত্য যেমন, অন্যান্য ধর্মনীতিও তেমনি। যদি বিবেচনা করো পরার্থপরতা আবশ্যক, এইজন্যই তাহা শ্ৰদ্ধেয়- যদি মনে করো, আজ আমি অপরের সাহায্য করিলে কাল সে আমার সাহায্য করবে, এইজন্যই পরের সাহায্য করিব—- তবে কখনোই পরের ভালোরূপ সাহায্য করিতে পার না ও সেই পরার্থপরতার প্রবৃত্তি কখনোই অধিক দিন টিকিবে না। কিসের বলেই বা টিকিবো! হিমালয়ের বিশাল হৃদয় হইতে উচ্ছসিত হইতেছে বলিয়াই গঙ্গা এত দিন অবিচ্ছেদে আছে, এত দূর অবাধে গিয়াছে, তাই সে এত গভীর, এত প্রশস্ত; আর এই গঙ্গা যদি আমাদের পরম সুবিধাজনক কলের পাইপ হইতে বাহির হইত। তবে তাহা হইতে বড়ো জোর কলিকাতা শহরের ধুলাগুলা কাদা হইয়া উঠিত, আর কিছু হইত না! গঙ্গার জলের হিসাব রাখিতে হয় না; কেহ যদি গ্ৰীষ্মকালে দুই কলসী অধিক তোলে বা দুই অঞ্জলি অধিক পান করে তবে টানাটানি পড়ে নাআর কেবলমাত্র কল হইতে যে জল বাহির হয় একটু খরচের বাড়াবাড়ি পড়িলেই ঠিক আবশাকের সময় সে তিরোহিত হইয়া যায়। যে সময়ে তৃষা প্ৰবল, রৌদ্র প্রখর, ধরণী শুষ্ক, যে সময়ে শীতল জলের আবশ্যক সর্বাপেক্ষা অধিক, সেই সময়েই সে নলের মধ্যে তাতিয়া উঠে, কলের মধ্যে ফুরাইয়া যায় ! বৃহৎ নিয়মে ক্ষুদ্র কাজ অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু সেই নিয়ম যদি বৃহৎ না হইত। তবে তাহার দ্বারা ক্ষুদ্র কাজটুকু ও অনুষ্ঠিত হইতে পারিত না ; একটি পাকা আপেল ফল যে পৃথিবীতে খসিয়া পড়িবে তাহার জন্য চরাচরব্যাপী ভারাকর্ষণ-শক্তির আবশ্যক- একটি ক্ষুদ্র পালের নীেকা চলিবে কিন্তু পৃথিবী বেষ্টনকারী বাতাস চাই! তেমনি সংসারের ক্ষুদ্র কাজ চালাইতে হইবে এইজন্য অনন্ত-প্রতিষ্ঠিত সমাজ পরিবর্তনশীল, কিন্তু তাহার প্রতিষ্ঠাস্থল ধ্রুব হওয়া আবশ্যক । আমরা জীবগণ চলিয়া বেড়াই, কিন্তু আমাদের পায়ের নীচেকার জমিও যদি চলিয়া বেড়াইত তাহা হইলে বিষম গোলযোগ বাধিত । বুদ্ধিবিচারগত আদর্শের উপর সমাজপ্রতিষ্ঠা করিলে সেই চঞ্চলতার উপর সমাজপ্রতিষ্ঠা করা হয়— মাটির উপর পা রাখিয়া বল পাই না, কোনো কাজই সতেজে করিতে পারি না । সমাজের আটালিকা নির্মাণ করি, কিন্তু জমির উপরে ভরসা না থাকাতে পাকা গাথুনি করিতে ইচ্ছা যায় না- সুতরাং ঝড় বহিলে তাহা সবসুদ্ধ ভাঙিয়া আমাদের মাথার উপরে আসিয়া পড়ে। সুবিধার অনুরোধে সমাজের ভিত্তিভূমিতে যাহারা ছিদ্ৰ খনন করেন, তাহারা অনেকে আপনাদিগকে বিজ্ঞ practical বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকেন। তাহারা এমন প্ৰকাশ করেন যে, মিথ্যা কথা বলা মন্দ, কিন্তু political উদ্দেশ্যে মিথ্যা কথা বলিতে দোষ নাই! সত্য ঘটনা বিকৃত করিয়া বলা উচিত নহে, কিন্তু তাহা করিলে যদি কোনো ইংরাজ অপদস্থ হয় তবে তাহাতে দোষ নাই। কপটতাচরণ ধর্মবিরুদ্ধ, কিন্তু দেশের আবশ্যক বিবেচনা করিয়া বৃহৎ উদ্দেশ্যে কপটতাচরণ অন্যায় নহে। কিন্তু বৃহৎ কাহাকে বলো! উদ্দেশ্য যতই বৃহৎ হউক-না কেন, তাহা অপেক্ষা বৃহত্তর উদ্দেশা আছে। বৃহৎ উদ্দেশ্য সাধন করিতে গিয়া বৃহত্তর উদ্দেশ্য ধ্বংস হইয়া যায় যে! হইতেও পারে, সমস্ত জাতিকে মিথ্যাচরণ করিতে শিখাইলে আজিকার মতো একটা সুবিধার সুযোগ হইল- কিন্তু তাহাকে যদি দৃঢ় সত্যানুরাগ শিখাইতে, তাহা হইলে সে যে চিরদিনের মতো মানুষ হইতে পারিত ! সে যে নিৰ্ভয়ে মাথা তুলিয়া দাড়াইতে পারিত, তাহার হৃদয়ে যে অসীম বল জন্মাইত। তাহা ছাড়া, সংসারের কার্য আমাদের অধীন নহে। আমরা যদি কেবলমাত্র একটি সূচি অনুসন্ধান করিবার জন্য দীপ জ্বালাই সে সমন্ত ঘর আলো