পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S SO রবীন্দ্র-রচনাবলী উত্তর- স্থায়ী সুখকে বলে। তদুত্তর- আচ্ছা, সে কথা আমি বুঝিব। আমার সুখ আমার কাছে। ভালোমন্দ বলিয়া চরম কিছুই নাই আবশ্যক অনাবশ্যক লইয়া কথা হইতেছে; আপাতত অস্থায়ী সুখই আমার আবশ্যক বলিয়া বোধ হইতেছে। তাহা ছাড়া পরের অহিত করিয়া আমি যে সুখ কিনিয়াছি তাহাই যে স্থায়ী নহে তাহার প্ৰমাণ কী ? প্ৰবঞ্চনা করিয়া যে টাকা পাইলাম তাহা যদি আমরণ ভোগ করিতে পাই, তাহা হইলেই আমার সুখ স্থায়ী হইল। ইত্যাদি ইত্যাদি। এইখানেই যে তর্ক শেষ হয় তাহা নয়। এই তর্কের সোপান বাহিয়া উত্তরোত্তর গভীর হইতে গভীরতর গহবরে নামিতে পারা যায়- কোথাও আর তল পাওয়া যায় না, অন্ধকার ক্রমশই ঘনাইতে থাকে; তরণীর আশ্রয়কে হেয়ম্ভজ্ঞানপূর্বক প্রবল গর্বে আপনাকেই আপনার আশ্রয় জ্ঞান করিয়া অগাধ জলে ডুবিতে শুরু করিলে যে দশা হয় আত্মার সেই দশা উপস্থিত হয়। আর, লোকহিত তুমিই বা কী জান, আমিই বা কী জানি!! লোকের শেষ কোথায়? লোক বলিতে বর্তমানের বিপুল লোক ও ভবিষ্যতের অগণ্য লোক বুঝায়। এত লোকের হিত কখনোই মিথ্যার দ্বারা হইতে পারে না। কারণ মিথ্যা সীমাবদ্ধ, এত লোককে আশ্রয় সে কখনোই দিতে পারে না। বরং মিথ্যা একজনের কাজে ও কিছুক্ষণের কাজে লাগিতে পারে, কিন্তু সকলের কাজে ও সকল সময়ের কাজে লাগিতে পারে না। লোকহিতের কথা যদি উঠে তো আমরা এই পর্যন্ত বলিতে পারি যে, সত্যের দ্বারাই লোকহিত হয়- কারণ, লোক যেমন অগণ্য, সত্য তেমনি অসীম । যেখানে দুর্বলতা সেইখানেই মিথ্যা প্ৰবঞ্চনা, কপটতা, অথবা যেখানে মিথ্যা প্ৰবঞ্চনা কপটতা সেইখানেই দুর্বলতা। তাহার কারণ, মানুষের মধ্যে এমন আশ্চর্য একটি নিয়ম আছে, মানুষ নিজের লাভ ক্ষতি সুবিধা গণনা করিয়া চলিলে যথেষ্ট বল পায় না। এমন-কি, ক্ষতি, অসুবিধা, মৃত্যুর সম্ভাবনাতে তাহার বল বাড়াইতেও পারে। practical লোকে যে-সকল ভাবকে নিতান্ত অবজ্ঞা করেন, কার্যের ব্যাঘাতজনক জ্ঞান করেন, সেই ভাব নিহিলে তাহার কাজ ভালোরূপ চলেই না। সেই ভাবের সঙ্গে বুদ্ধি বিচার তর্কের সম্পূৰ্ণ ঐক্য নাই! বুদ্ধি বিচার তর্ক আসিলেই সেই ভাবের বল চলিয়া যায় । এই ভাবের বলে লোকে যুদ্ধে জয়ী হয়, সাহিত্যে অমর হয়, শিল্পে সুনিপুণ হয়- সমস্ত জাতি ভাবের বলে উন্নতির দুৰ্গম শিখরে উঠিতে পারে, অসম্ভবকে সম্ভব করিয়া তুলে, বাধা বিপত্তিকে অতিক্রম করে এই ভাবের প্রবাহ যখন বন্যার মতো সরল পথে অগ্রসর হয় তখন ইহার অপ্ৰতিহত গতি ; আর যখন ইহা বক্ৰবুদ্ধির কাটা নালা-নর্দামার মধ্যে শত ভাগে বিভক্ত হইয়া আঁকিয়া বাকিয়া চলে তখন ইহা উত্তরোত্তর পঙ্কের মধ্যে শোষিত হইয়া দুৰ্গন্ধ বাম্পের সৃষ্টি করিতে থাকে। ভাবের এত বল কেন ? কারণ, ভাব অত্যন্ত বৃহৎ । বুদ্ধি বিবেচনার ন্যায় সীমাবদ্ধ নহে! লাভ ক্ষতির মধ্যে তাহার পরিধির শেষ নহে, বস্তুর মধ্যে সে রুদ্ধ নহে। তাহার নিজের মধ্যেই তাহার নিজের অসীমতা। সম্মুখে যখন মৃত্যু আসে তখনো সে অটল, কারণ ক্ষুদ্র জীবনের অপেক্ষা ভাব বৃহৎ। সম্মুখে যখন সৰ্ব্বনাশ উপস্থিত তখনো সে বিমুখ হয় না, কারণ লাভের অপেক্ষাও ভাব বৃহৎ। স্ত্রী পুত্র পরিবার ভাবের নিকট ক্ষুদ্র হইয়া যায়। আমাদের জাতি নূতন ইটিতে শিখিতেছে, এ সময়ে বৃদ্ধ জাতির দৃষ্টান্ত দেখিয়া ভাবের প্রতি ইহার অবিশ্বাস জন্মাইয়া দেওয়া কোনোমতেই কর্তব্য বোধ হয় না। এখন ইতস্তত করিবার সময় নহে। এখন ভাবের পতাকা আকাশে উড়াইয়া নবীন উৎসাহে জগতের সমরক্ষেত্রে প্রবেশ করিতে হইবে। এই বাল্য-উৎসাহের স্মৃতিই বৃদ্ধ সমাজকে সতেজ করিয়া রাখে। এই সময়ে ধর্ম, স্বাধীনতা, বীরত্বের যে-একটি অখণ্ড পরিপূর্ণ ভাব হৃদয়ে জাজ্বল্যমান হইয়া উঠে তাহারই সংস্কার বৃন্ধকাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এখনই যদি হৃদয়ের মধ্যে ভাঙ্গাচোরা টলমল অসম্পূর্ণ প্রতিমা, তবে উত্তরকালে তাহার জীৰ্ণ ধূলি মাত্র অবশিষ্ট থাকিবে। জীবনের আদর্শকে সীমাবদ্ধ করিয়া কখনোই জাতির উন্নতি হুইবে না। উদারতা নাহিলে কখনোই মহাৱের স্মৃর্তি হইবে না। মুখশ্ৰীতে যে-একটি দীপ্তির বিভাস হয়, হৃদয়ের মধ্যে যে-একটি প্রতিভার