পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ܓ 9 ܠ রাজভক্তির প্রচুর আস্ফালন করেন, সেইরূপ ভাবই কি তোমরা প্রার্থনীয় জ্ঞান করা ? আমাদের একমাত্র বিশ্বাস কথার উপরে— হয়তো আমাদের কোনো কোনো মুসলমান ভ্রাতার তাহা নাই- এজন্য বরং তোমাদের নিকট হইতেও আমরা বাকাবাগীশ নামে অভিহিত হইতে রাজি আছি, তথাপি কনগ্রেসের বিরোধী পক্ষে যোগ দিতে পারিব না। তোমাদের প্রতি ভক্তি আছে বলিয়াই কথা কহি নহিলে নীরব হইয়া থাকিতাম তাহার। আর সন্দেহ নাই। অতএব তোমরা কনগ্রেসের প্রতি সন্দিগ্ধভােব দূর কবিয়া কনগ্ৰেসেৰ চতুর মৌনী বিরোধী পক্ষের প্রতি সন্দেহ স্থাপন করো। কনগ্রেস আর এক উপায়ে রাজভক্তি শিক্ষা দিতেছে। ইংরাজেরই মহিমা কনগ্রেসের অস্থিমজার মধ্যে জীবন সঞ্চার করিতেছে। ইংরাজেরই মহৎ উজ্জ্বল অপূর্ব নিঃস্বাৰ্থ গ্ৰীতি কনগ্রেসের মর্মের মধ্যে প্রতিষ্ঠা স্থাপন করিয়া তাহাকে অলৌকিক বলে বলীয়ান করিতেছে। বাহিরে পায়োনিয়রের স্তম্ভে, রাজকর্মচারীদের প্রকাশ্য ও গোপন কার্যপ্ৰণালীর মধ্যে ইংরাজের যে অনুদারতার পরিচয় পাইতেছি— এ দিকে দুৰ্ভাগা দরিদ্র জাতির জন্য হিউমের সম্পূর্ণ আত্মবিসর্জন, ইউল ও বেডরবনের জোতির্ময় সহৃদয়তা আমাদের অত্যন্ত নিকটে থাকিয়া আমাদের ইংরাজ জাতি যে কত মহৎ কনগ্রেস না থাকিলে তাহাব এমন নিকট প্রমাণ পাইবার আমাদের অবসর হইত না ! সেই প্ৰমাণ পাইবার অত্যন্ত আবশাক হইয়াছিল। ভারতবর্ষে ইংরাজ্যে এবং ভারতবষীয়ের মধ্যে প্রত্যক্ষ স্বার্থের সংঘর্ষ— এবং ইংরাজ এখানে প্রভুপদে প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতামদে মত্ত, সুতরাং স্বভাবত ইংরাজের ব্যক্তিগত মহত্ত্ব ভারতবর্ষে তেমন স্ফর্তি পায় না, বরঞ্চ তাহার ক্ষুদ্রতা নিষ্ঠুরতা ও দানবভাব অনেক সময়ে সজাগ হইয়া উঠে । এ দিকে ইংরাজি সাহিতো আমরা ইংরাজি চরিত্রের উচ্চ আদর্শ দেখিতে পাই অথচ সাক্ষাৎ সম্পর্কে ইংরাজের মধ্যে তােহর পরিচয় পাই না- এইরূপে যুরোপীয় সভ্যতার উপর আমাদের ইংরাজের উনবিংশ শতাব্দীর সম্পর্ধিত সভ্যতার উপর এইরূপ একটা ঘোরতব সংশয় জন্মিয়াছে। সমস্ত ফাকি বলিয়া মনে হইতেছে! সকলে ভীত হইয়া মনে করিতেছেন আমাদের প্রাচীন রীতিনীতির জীণ দুর্গের মধ্যে আশ্রয় লওয়াই সর্বাপেক্ষা নিরাপদ , ইংরাজি সভ্যতার মধ্যে সহৃদয়ত ও অকৃত্রিমতা নাই । ইহার প্রধান কারণ ইংরাজের নিকট হইতে সহৃদয়ত প্ৰতাশা করিয়া আমরা নিরাশ হইয়াছি, এবং আমাদের আহত হৃদয়ের বেদনায় ইংরাজি সভ্যতাকে আমরা সম্পৰ্ণ অস্বীকার করিতে চেষ্টা করিতেছি । এমন সময়ে হিউম, ইউল, বেড়রাবন কনগ্রেসকে অবলম্বন করিয়া আমাদের সেই নষ্ট বিশ্বাস উদ্ধার করিতে অগ্রসর হইয়াছেন; ইহাতে যে কেবল আমাদের রাজনৈতিক উন্নতি হইবে তাহা নহে ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমরা যে নূতন শিক্ষা নূতন সভ্যতার আশ্রয়ে আনীত হইয়াছি তাহার প্রতি বিশ্বাস বলিষ্ঠ হইয়া তাহার সুফলসকল স্বেচ্ছাপূর্বক অন্তরের মধ্যে গ্ৰহণ করিতে পারিব এবং এইরূপে আমাদের সর্বাঙ্গণ উন্নতি হইবে ; আমরা ইতিহাসে ও সাহিত্যে ইংরাজের যে মহৎ আদর্শ লাভ করিয়াছি সেই আদশ মূর্তিমান ও জীবন্ত হইয়া আমাদিগকে মনুষ্যত্বের পথে অগ্রসর করিয়া দিবে। আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রের মধ্যে যতই সাধুপ্রসঙ্গ ও সৎশিক্ষা থাক তাহা এক হিসাবে মৃত, কারণ যে-সকল মহাপুরুষেরা সেই সাধুভাব সকলকে প্রধান করিয়াছিলেন এবং তাহা হইতে পুনশ্চ প্ৰাণলাভ করিয়াছিলেন, তাহারা আর বর্তমান নাই- কেবল শুষ্ক শিক্ষায় অসাড় জীবনকে চৈতনাদান করিতে পারে না। আমরা মানুষ চাই। বর্তমান সভ্যতা যাহাদিগকে মহৎজীবন দান করিয়াছে এবং যাহারা বর্তমান সভ্যতাকে সেই জীবন প্ৰত্যপণ করিয়া সঞ্জীবিত করিয়া রাখিয়াছেন সেই-সকল মহাপুরুষের মহৎ প্রভাব প্ৰত্যক্ষ অনুভব করিতে চাই, তবে আমাদের শিক্ষা ও চরিত্র সম্পূর্ণতা লাভ করিবে। হিউমকে নিকটে পাইয়া আমাদের ইংরাজি ইতিহাসশিক্ষার ফল সম্পূর্ণতা প্রাপ্ত হইতেছে— নতুবা আমরা যে-সকল উদাহরণ দেখিয়াছি ও দেখিতেছি, তাহাতে সে শিক্ষা অনেক পরিমাণে নিৰ্ম্মফল হইয়া যাইতেছিল।