পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Sw8 রবীন্দ্র-রচনাবলী জান না, জানিতে ইচ্ছাও করো না- তথাপি দুরাশায় ভর করিয়া আমাদের কনগ্রেসের প্রতি তোমাদের অকারণ অবিশ্বাস দূর করিবার জন্য মাঝে হইতে তৎসম্বন্ধে এতটা কথা বলিলাম। দেখাইলাম তোমাদের প্রতি তিক্তিই কনগ্রেসের একমাত্র আশা ও সম্বল। অতএব কনগ্রেসের নিকট হইতে যে প্রস্তাব উত্থাপিত হইতেছে তাহার প্রতি এমন ভুকুটি করিয়া থাকা তোমাদের বিবেচনার ভুল। তাহার প্রতি প্ৰসন্ন কর্ণপাত করা রাজনৈতিক ধৰ্মনৈতিক সকল প্রকার কারণে তোমাদের কর্তব্য। কারণ, কনগ্রেস জেতু ও জিতজাতির মধ্যে সেতুবন্ধন করিয়া দিতেছে। গবর্মেন্টের দ্বারা মন্ত্রিনিয়োগ অপেক্ষা সাধারণ লোকের দ্বারা মন্ত্রি-অভিষেক অনেক কারণে আমাদের নিকটে প্রার্থনীয় মনে হয়। পূর্বেই বলিয়াছি সম্ভোষ একটি প্রধান কারণ। আমাদের শিক্ষিতমণ্ডলী এই অধিকার প্রার্থনা করিতেছে। যদি ইহা দান করিলে গবর্মেন্টের কোনো ক্ষতি না হয় তো প্ৰজারঞ্জন একটা মহৎলাভ। গবর্মেন্ট শব্দটা শুনিবা মাত্র হঠাৎ ভ্ৰম হয় যেন তাহা মানবধর্মবিবর্জিত নিৰ্গুণ পদার্থ। যেন তাহা রাগদ্বেষবিহীন। যেন তাহা স্তবে বিচলিত হয় না, বাহ্য চাকচিকো ভোলে না, যেন তাহার আত্মপরবিচার নাই, যেন তাহা নিরপেক্ষ কটাক্ষের দ্বারা মন্ত্রবলে মানবচরিত্রের রহস্য ভেদ করিতে পারে। অতএব এরূপ অপেক্ষপাতী সর্বদশী অলৌকিক পুরুষের হস্তেই নির্বাচনের ভার থাকিলেই যেন उ८ श। কিন্তু আমরা নিশ্চয় জানি গবর্মেন্ট আমাদেরই ন্যায় অনেকটা রক্তেমাংসে গঠিত। উক্ত গবমেন্ট নিমন্ত্রণে যান, বিনীত সম্ভাষণে আপ্যায়িত হন, লনটেনিস খেলেন, মহিলাদের সহিত মধুরালাপ করেন এবং অধম আমাদেরই মতো সামাজিক স্তুতিনিন্দায় বহুল পরিমাণে বিচলিত হইয়া থাকেন। অতএব, এ স্থলে গবর্মেন্টের দ্বারা নির্বাচনের অর্থ আর কিছুই নয়, একটি বা দুইটি বা অল্পসংখ্যক ইংরাজের দ্বারা নির্বাচন। কিন্তু আমরা পদে পদে প্ৰমাণ পাইয়াছি ভারতবর্ষীয় ইংরাজেরা নব্য শিক্ষিত সম্প্রদায়ের প্রতি একান্ত অনুরক্ত নহেন। কারণ, নবারুচি অনুসারে ইহারা চশমা ব্যবহার করেন, দাড়ি রাখেন, ইংরাজি জুতা পরেন, এবং সে জুতা সহজে খুলিতে চাহেন না! তদ্ভিন্ন ইহাদের স্বাতন্ত্র্যাপ্রিয়তা, ইহাদের ঔদ্ধতা, ইহাদের বক্ততাশক্তি প্ৰভৃতি নানা কারণে তাহারা একান্ত উদবেজিত হইয়া আছেন। অতএব তাহদের হস্তে নির্বাচনের ভার থাকিলে এই শিক্ষিত দলের পক্ষে বড়ো আশার কারণ নাই। ইহাদের দৰ্প চূৰ্ণ করা তাহারা রাজনৈতিক কর্তব্য জ্ঞান করেন। অতএব শিক্ষিত লোকেরা তাহদের দ্বারে প্রার্থী হইয়া দাড়াইলে কেবল যে নিরাশ হইয়া ফিরিয়া আসিবেন তাহা নহে, উপরন্তু সাহেবের নিকট দুটাে শ্রুতিপরুষ অথচ বাৎসল্যগৰ্ভ উপদেশ শুনিয়া এবং প্রবেশাধিকারের মূল্যস্বরূপ দ্বারীকে কিঞ্চিৎ দণ্ড দিয়া আসিতে হইবে। কিন্তু ইংরাজি শিক্ষা কিছু এমনি বিড়ম্বনা নহে যে কেবল শিক্ষিত ব্যক্তিরাই সকল প্রকার যোগ্যতা লাভে অক্ষম হইয়াছেন। অতএব শিক্ষিত ব্যক্তিদের প্রতি ভারতবর্ষীয় ইংরাজের এই-যে বিরাগ তাহা কেবল ব্যক্তিগত রুচিবিকার মাত্র, তাহা যুক্তিসংগত ন্যায়সংগত নহে। তদ্ভিন্ন তাহারা কয় জন দেশীয় উপযুক্ত লোককে রীতিমত জানেন? তাহদের নির্বাচনক্ষেত্রের পরিধি কতই সংকীর্ণ ! উপাধিবান রাজা উপরাজার সহিতই তাহদের কিয়ৎপরিমাণ মৌখিক আলাপ আছে মাত্র । মন্ত্রিসভায় আসন পাওয়া যাহারা কেবলমাত্র সম্মান বলিয়া জ্ঞান করেন, জীবনের গুরুতর কর্তব্য বলিয়া জ্ঞান করেন না, তাহারাই অধিকাংশ সময়ে সেখানে স্থান পাইয়া থাকেন। অবশ্য, সময়ে সময়ে ইহার ব্যতিক্রমও ঘটিয়াছে। অনেক যোগ্য ব্যক্তিও স্থান পাইয়াছেন সন্দেহ নাই। তাহদের মধ্যে কাহারও কাহারও সহিত বর্তমান বক্তার পরম গৌরবের আত্মীয়তাসম্পর্ক আছে। কিন্তু সে-সকল যোগ্য ব্যক্তি সাধারণের অপরিচিত নহেন। সাধারণের দ্বারা তাহদের নির্বাচিত হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা ছিল।