পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

N 8 V রবীন্দ্র-রচনাবলী কর্মকে ব্ৰহ্মের কর্ম বলিয়াই জানে। আর্যধর্মের বিশুদ্ধ আদর্শ হইতে যাহারা ভ্ৰষ্ট হইয়াছেন তাহারা বলিবেন সংসারের সহিত যদি ব্ৰহ্মের যোগ সাধন করিতে হয়, তবে ব্ৰহ্মাকে সংসারের উপযোগী করিয়া গড়িয়া লইতে হইবে। তাই যদি হইল তবে সত্যের প্রয়োজন কী? সংসার তো আছেই- কাল্পনিক সৃষ্টির দ্বারা সেই সংসারেরই আয়তন বিস্তার করিয়া লাভ কী ? আমরা অসৎ সংসারে আছি বলিয়াই আমাদের সত্যের প্রয়োজন- অমরা সংসারী বলিয়াই সেই সংসারাতীত নির্বিকার অক্ষর পুরুষের আদর্শ উজ্জ্বল করিয়া রাখিতে হইবেসে আদর্শ বিকৃত হইতে দিলেই তাহা সছিদ্র তরণীর ন্যায় আমাদিগকে বিনাশ হইতে উৰ্ত্তীর্ণ হইতে দেয় না। যদি সন্তাকে, জোতিকে, অমৃতকে আমরা অসং অন্ধকার এবং মৃত্যুর পরিমাপে খর্ব করিয়া আনি, আসতো মা সদগময়, তমসো মা জোতিগময়, মৃতোমামৃতং গময়। সংসারী জীবের পক্ষে একটি মাত্র প্রার্থনা আছে- সে প্রার্থনা, অসৎ হইতে আমাকে সতো লইয়া যাও, অন্ধকার হইতে আমাকে জ্যোতিতে লইয়া যাও, মৃত্যু হইতে আমাকে অমৃতে লইয়া যাও— সে প্রার্থনা করিবার স্থান সংসারে নাই, আমাদের কল্পনার মধো নাই- সীতাকে মিথ্যা করিয়া লইয়া তাহার নিকট সত্যের জন্য ব্যাকুলতা-প্রকাশ চলে না, জ্যোতিকে স্বেচ্ছাকৃত কল্পনার দ্বারা অন্ধকারে আচ্ছন্ন করিয়া তাহার নিকট আলোকের জনা প্রার্থনা বিড়ম্বনা মাত্র, অমৃতকে স্বহস্তে মৃত্যুধর্মের দ্বারা বিকৃত করিয়া তাহার নিকট অমৃতের প্রত্যাশা মূঢ়তা ! ঈশাবাসামিদং সৰ্ববং যৎকিঞ্চি জগতাং জগৎ- যে ব্ৰহ্ম সমস্ত জগতের সমস্ত পদার্থকে আচ্ছন্ন কবিয়া বিরাজ করিতেছেন, সংসারী সেই ব্ৰহ্মকেই সর্বত্র অনুভব করিবেন উপনিষদের এই অনুশাসন ! ব্ৰহ্মের সেই বিশুদ্ধ ভাব কিরূপে মনন করিতে হইবে ? নৈনমূদ্ধং ন তির্যাঞ্চং ন মধ্যে পরিাজগ্রভৎ ন তস্য প্রতিমা অস্তি যস্য নাম মহদযশ: | কি উর্ধবদেশ, কি তির্যক, কি মধ্যাদেশ, কেহ ইহাকে গ্ৰহণ করিতে পারে না— তাহার প্রতিমা নাই, প্রাচীন ভারতে সংসারবাসী জীবাত্মার লক্ষ্যস্থান এই পরমাত্মাকে বিদ্ধ করিবার মন্ত্র ছিল ওঁ । প্ৰণবো ধনুঃ শবো হা হ্র" ব্ৰহ্ম তল্লক্ষ্যমুচ্যতে। তাহার প্রতিমা ছিল না, কোনো মূর্তিকল্পনা ছিল না- পূর্বতন পিতামহগণ তাহাকে মনন করিবার জন্য সমস্ত পরিত্যাগ করিয়া একটিমাত্র শব্দ আশ্রয় করিয়াছিলেন। সে শব্দ যেমন সংক্ষিপ্ত, তেমনি পরিপূর্ণ, কোনো বিশেষ অর্থ-দ্বারা সীমাবদ্ধ নহে! সেই শব্দ চিত্তকে ব্যাপ্ত করিয়া দেয়, কোনো বিশেষ আকার-দ্বারা বাধা দেয় না; সেই একটি মাত্র ওঁ শব্দের মহাসংগীত জগৎসংসারের ব্ৰহ্মরন্ধ হইতে যেন ধবনিত হইয়া উঠিতে থাকে। ব্ৰহ্মের বিশুদ্ধ আদর্শ রক্ষা করিবার জন্য পিতামহগণ কিরূপ যত্নবান ছিলেন ইহা হইতেই তাহার প্ৰমাণ হইবে । চিস্তার যত প্রকার চিহ্ন আছে। তন্মধ্যে ভাষাই সর্বাপেক্ষা চিন্তার অনুগামী । কিন্তু ভাষারও সীমা আছে, বিশেষ অর্থের দ্বারা সে আকারবদ্ধ-সুতরাং ভাষা আশ্রয় করিলে চিন্তাকে ভাষাগত অর্থের চারি প্রান্তের মধ্যে রুদ্ধ থাকিতে হয়। ওঁ একটি ধ্বনিমাত্ৰ- তাহার কোনো বিশেষ নির্দিষ্ট অর্থ নাই। সেই ঔ শব্দে ব্ৰহ্মের ধারণাকে কোনো অংশেই সীমাবদ্ধ করে না- সাধনা-দ্বারা আমরা ব্ৰহ্মকে যত দূর জানিয়াছি যেমন করিয়াই পাইয়াছি, এই ও শব্দে তাহ সমস্তই ব্যক্ত করে, এবং ব্যক্ত করিয়াও সেইখানেই রেখা টানিয়া দেয় না। সংগীতের স্বর। যেমন গানের কথার মধ্যে একটি অনির্বাচনীয়তার সঞ্চার করে তেমনি ও শব্দের পরিপূর্ণ ধ্বনি আমাদের ব্ৰহ্মধ্যানের মধ্যে একটি অব্যক্ত অনির্বচনীয়তা অবতারণা করিয়া থাকে। বাহ্য প্ৰতিমাদ্বারা আমাদের মানস ভাবকে খর্ব ও আবদ্ধ করে, কিন্তু এই ঔ ধবনির দ্বারা আমাদের মনের