পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঔপনিষদ ব্ৰহ্ম Σ ( S ইহাই আমাদের ধর্মক্ষেত্র, ইহাই ব্ৰহ্মের মন্দির। এখানে জগৎমণ্ডলের জ্ঞানে ঈশ্বরের জ্ঞান, জগৎসৌন্দর্যের ভোগে ঈশ্বরের ভোগ এবং জগৎসংসারের কর্মে ঈশ্বরের কর্ম জডিত রহিয়াছে— সংসারের সেই জ্ঞান সৌন্দর্য ও ক্রিয়াকে ব্রহ্মের দ্বারা বেষ্টিত করিয়া জানিলেই ব্ৰহ্মকে অন্তরতর করিয়া জানা যায় এবং সংসারযাত্ৰাও কল্যাণকর হইয়া উঠে। তখন ত্যাগ এবং ভোগের সামঞ্জস্য হয়, কাহারও ধনে লোভ থাকে না, অনৰ্থক বলিয়া জীবনের প্রতি উপেক্ষা জন্মে না, শতবর্ষ। আয়ু যাপন করিলেও পরমায়ুর সার্থকতা উপলব্ধি হয়, এবং সেই অবস্থায়— যন্ত সর্বাণি ভুতানি আত্মন্যেবানুপশ্যতি সৰ্ব্বভুতেষু চাত্মানং ততো ন বিজুগুঙ্গতে। যিনি সমস্ত ভূতকে পরমাত্মার মধ্যে দেখেন এবং সর্ব ভূতের মধ্যে পরমাত্মাকে দেখেন , তিনি কাহাকেও ঘূণা করেন না। গম্যস্থানের পক্ষে পথ যেমন একই কালে পরিহার্য এবং অবলম্বনীয়, ব্ৰহ্মলাভের পক্ষে সংসার সেইরূপ। পথকে যেমন আমরা প্রতিপদে পরিত্যাগ করি এবং আশ্রয় করি, সংসার ও সেইরূপ আমাদের প্রতিপদে বর্জনীয় এবং গ্রহণীয়। পথ নাই বলিয়া চক্ষু মুদিয়া পথপ্ৰান্তে পডিয়া স্বপ্ন দেখিলে গৃহলাভ হয় না, এবং পথকেই শেষ লক্ষ্য বলিয়া বসিয়া থাকিলে গৃহে গমন ঘটে না। গম্যস্থানকে যে ভালোবাসে পথকেও সে ভালোবাসে ; পথ গমস্থানেরই অঙ্গ অংশ এবং আরম্ভ বলিয়া গণ্য। ব্ৰহ্মকে যে চায়, ব্ৰহ্মের সংসারকে সে উপেক্ষা করিতে পারে না- সংসারকে সে প্রীতি করে এবং সংসারের কর্মকে ব্ৰক্ষের কর্ম বলিয়াই জানে। আর্যধর্মের বিশুদ্ধ আদর্শ হইতে যাহারা ভ্ৰষ্ট হইয়াছেন তাহারা বলিবেন সংসারের সহিত যদি ব্ৰহ্মের যোগসাধন করিতে হয় তবে ব্ৰহ্মকে সংসারের উপযোগী করিয়া গড়িয়া লইতে হইবে। তাই যদি হইল তবে সত্যের প্রয়োজন কী? সংসার তো আছেই- কাল্পনিক সৃষ্টির দ্বারা সেই সংসারেরই আয়তন বিস্তার করিয়া লাভ কী? আমরা অসৎ সংসারে আছি বলিয়াই আমাদের সত্যের প্রয়োজন, আমরা সংসারী বলিয়াই সেই সংসারাতীত নির্বিকার অক্ষর পুরুষের আদর্শ উজ্জ্বল করিয়া রাখিতে হইবেসে আদর্শ বিকৃত হইতে দিলেই তাহ, সছিদ্র তরণীর ন্যায়, আমাদিগকে বিনাশ হইতে উত্তীর্ণ হইতে দেয় না। যদি সত্যকে, জ্যোতিকে, অমৃতকে আমরা অসৎ অন্ধকার এবং মৃত্যুর পরিমাপে খর্ব করিয়া আসতো মা সদগময়, তমসো মা জ্যোতিৰ্গময়, মৃতোর্মামৃতং গময় ? সংসারী জীবের পক্ষে একটি মাত্র প্রার্থনা আছে- সে প্রার্থনা অসৎ হইতে আমাকে সত্যে লইয়া যাও, অন্ধকার হইতে আমাকে জ্যোতিতে লইয়া যাও, মৃত্যু হইতে আমাকে অমৃতে লইয়া যাও। সত্যকে মিথ্যা করিয়া লইয়া তাহার নিকট সত্যের জন্য ব্যাকুলতা প্রকাশ চলে না, জ্যোতিকে স্বেচ্ছাকৃত কল্পনার দ্বারা অন্ধকারে আচ্ছন্ন করিয়া তাহার নিকট আলোকের জন্য প্রার্থনা বিড়ম্বন মাত্র, অমৃতকে স্বহস্তে মৃত্যুধর্মের দ্বারা বিকৃত করিয়া তাহার নিকট অমৃতের প্রত্যাশা মূঢ়তা। ঈশাবাস্যমিদং সৰ্ববং যৎকিঞ্চি জগত্যাং জগৎ- যে ব্ৰহ্ম সমস্ত জগতের সমস্ত পদার্থকে আচ্ছন্ন করিয়া বিরাজ করিতেছেন সংসারী সেই ব্ৰহ্মকেই সর্বত্র অনুভব করিবেন উপনিষদের এই অনুশাসন। দ্বিধাগ্ৰস্ত ব্যক্তি বলিবেন, উপদেশ সত্য হইতে পারে। কিন্তু তাহা পালন কঠিন। অরূপ ব্ৰহ্মের মধ্যে দুঃখশোকের নির্বাপণ সহজ নহে। কিন্তু যদি সহজ না হয় তবে দুঃখনিৰ্বাপণের, মুক্তিলাভের অন্য যে-কোনো উপায় আরো কঠিন- কঠিন কেন, অসাধ্য। স্বতঃপ্রবাহিত অগাধ স্রোতস্বিনীর মধ্যে অবগাহনস্নান যদি কঠিন হয় তবে স্বহস্তে ক্ষুদ্রতম কৃপ খনন করিয়া তাহার মধ্যে অবতরণ আরো কত কঠিন- তাই বা কেন, নিজের ক্ষুদ্র কলস-পরিমিত জল নদী হইতে বহন করিয়া স্নান করা সেও দুরূহতার। যখন ব্ৰহ্মকে অরূপ অনন্ত অনির্বচনীয় বলিয়া জানি তখনই তাহার মধ্যে সম্পূৰ্ণ আত্মবিসর্জন অতি সহজ হয়, তখনই তাহার দ্বারা পরিপূর্ণরূপে পরিবৃত হইয়া আমাদের ভয় দুঃখ শোক সর্বাংশে দূর হইয়া যায়। এইজন্যই উপনিষদে আছে