পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ܔܛ ܠ তত্ত্বজ্ঞানপরায়ণঃ, তত্ত্বজ্ঞানী হইবেন, অর্থাৎ যে নিষ্ঠার কথা কহিলেন তাহা যেন অজ্ঞাননিষ্ঠা না হয়, গৃহী যথার্থ জ্ঞানপূর্বক ব্ৰহ্মে নিরত হইবেন এবং যদযদি কর্ম প্ৰকুবীত তদব্ৰহ্মণি সমৰ্পয়েৎ, যে যে কর্ম করিবেন তাহা ব্ৰহ্মে সমর্পণ করিবেন। অতএব শাস্ত্রের অনুশাসন এই যে, গৃহী ব্যক্তিকে কেবল ভক্তিতে নহে, জ্ঞানে- কেবল, জ্ঞানে নহে, কমে, হৃদয়ে মনে এবং চেষ্টায়, সর্বতোভাবে ব্ৰহ্মপরায়ণ হইতে হইবে। অতএব সংসারের মধ্যে থাকিয়া আমরা সর্বদা সর্বত্র ব্ৰহ্মের সত্তা উপলব্ধি করিব, অন্তরাত্মার মধ্যে তাহার অধিষ্ঠান অনুভব করিব এবং আমাদের সমুদয় কর্ম তাহার সম্মুখে কৃত এবং তাহার উদ্দেশে সমাপিত হইবে। করিয়া ব্ৰহ্মের মধ্যেই আপনাকে সম্পূৰ্ণ আশ্রিত আবৃত নিমগ্ন অনুভব করিতে হইলে, তাহাকে সাকাররূপে কল্পনাই করা যায় না। উপনিষদে আছে, যদিদং কিঞ্চি জগৎ সর্বং প্রাণ এজাতি নিঃসৃতংএই সমস্ত জগৎ সেই প্ৰাণ হইতে নিঃসৃত হইয়া সেই প্ৰাণের মধ্যে কম্পিত হইতেছে। অনন্ত প্ৰাণের মধ্যে সমস্ত বিশ্বচরাচর অহনিশি স্পন্দমান রহিয়াছে এই ভাব কি আমরা কোনোপ্রকার হস্তপদবিশিষ্ট মূর্তি-দ্বারা কল্পনা করিতে পারি? অথচ যদিদং কিঞ্চি জগৎ সর্বং প্রাণ এজতি, এই যাহা-কিছু জগৎ সমস্ত প্ৰাণের মধ্যে কম্পিত হইতেছে। এ কথা মনে উদয় হইবামাত্র তৎক্ষণাৎ তৃণগুল্মলতাপুষ্পপল্লব পশুপক্ষী মনুষ্য চন্দ্ৰসূৰ্যগ্রহনক্ষত্র, জগতের প্রত্যেক কম্পমান অণু পরমাণু, এক মহাপ্ৰাণের ঐক্যসমুদ্রে হিল্লোলিত দেখিতে পাই— এক মহাপ্ৰাণের অনন্তকম্পিত বীণাতন্ত্রী হইতে এই বিপুল বিচিত্র বিশ্বসংগীত ঝংকুত শুনিতে পাই। অনন্তপ্রাণের সেই অনিৰ্দেশ্যতা অনির্বাচনীয়তাই আমাদের চিত্তকে প্রসারিত করিয়া দেয়। সেই জগদব্যাপী জগদতীত প্ৰাণকে কোনো নির্দিষ্ট সংকীর্ণ আকারের মধ্যে কল্পনা করিতে গেলে তখন আর তাহাকে আমাদের নিশ্বাসের মধ্যে পাই না, আমাদের চক্ষের নিমেষের মধ্যে পাই না- আমাদের রক্তের উত্তপ্ত প্রবাহ, আমাদের সর্বাঙ্গের বিচিত্ৰ স্পৰ্শ, আমাদের দেহের প্রত্যেক স্পন্দিত কোষ, প্ৰত্যেক নিঃশ্বসিত রোমকৃপের মধ্যে পাই না- আকৃতির কঠিন ব্যবধানে, মূর্তির অলঙ্ঘনীয় অন্তরালে, তিনি আমাদের নিকট হইতে আমাদের অন্তর হইতে দূরে বাহিরে গিয়া পড়েন। আমার অশরীর অভাবনীয় প্ৰাণ আমার আদ্যোপান্তে অখণ্ডভাবে পরিব্যাপ্ত রাখিয়াছে— আবার আমার এই রহস্যময় প্ৰাণের মধ্যে সেই পরম প্ৰাণ আমার শরীরকোষের প্রত্যেক স্পন্দনের সহিত সুদূরতম নক্ষত্রবর্তী বাষ্পাণুর প্রত্যেক আন্দোলনকে এক অনির্বচনীয় ঐক্যে এক অপূর্ব অপরিমেয় ছন্দোবন্ধনে আবদ্ধ করিয়াছেন- ইহা অনুভব করিয়া এবং অনুভবের শেষ করিতে না পারিয়া কি আমাদের চিত্ত পুলকিত প্রসারিত হইয়া উঠে না ? কোনো মূর্তির কল্পনা কি ইহা অপেক্ষা সহজে আমাদিগকে সর্বপ্রকার ক্ষুদ্রতার বন্ধন, খণ্ডতার কারাপ্রাচার হইতে মুক্তিদানে সহায়তা করিতে পারে- অনন্তের সহিত আমাদের এমন অন্তরতম ব্যাপকতম যোগ সংনিবদ্ধ করিতে পারে ? সাকার মূর্তি আমাদিগকে সহায়তা করে না, ব্ৰহ্মকে দূরে লইয়া দুষ্পপ্রাপা করিয়া দেয়। অভয়ং প্রতিষ্ঠাং বিন্দতে অথ সোহভয়ংগতো ভবতি।। ২ যখন সাধক সেই অদৃশ্যে, অশরীরে, নির্বিশেষে, নিরাধারে অভয় প্রতিষ্ঠা লাভ করেন তখন তিনি अङग्न 2i९g ठून्म । যদা হোবৈষ এতস্মিনানুন্দরমন্তরং কুরুতে অথ তস্য ভয়ং ভবতি । কিন্তু যখন তিনি ইহাতে লেশমাত্র অন্তর অর্থাৎ দূরত্ব স্থাপন করেন তখন তিনি ভয় প্রাপ্ত হন। সেই অদৃশ্যকে দৃশ্য, অশরীরকে শরীরী, নির্বিশেষকে সবিশেষ এবং নিরাধারকে আধারবিশিষ্ট করিলে ব্ৰহ্মের সহিত দূরত্ব স্থাপন করা হয় এবং তখন আমাদের আত্মার অভয়প্রতিষ্ঠা চূৰ্ণ হইয়া যায়। উপনিষৎ বলিতেছেন অক্টাতি ব্ৰবতোহন্যত্র কথং তদুপলভ্যতে।