পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আলোচনা SV বক্ষস্থিত কীটের মতো গোটাকতক পাপড়ির মধ্যে কারারুদ্ধ করিয়া রাখে তাহা নহে। সে আরো তোমাকে এমন এক নূতন বিচরণের স্থানে লইয়া যায়, যেখানে এত বেশি স্বাধীনতা যে এক প্রকার অনিৰ্দেশ্য অনির্বাচনীয়তার মধ্যে হারা হইয়া যাইতে হয়। তখন এক প্রকার অস্ফুট দৈববাণীর মতো হৃদয়ের মধ্যে শুনিতে পাওয়া যায়, যে, সকলেরই মধ্যে অসীম আছে; যাহাকেই তুমি ভালোবাসিবে সেই তোমাকে তাহার অসীমের মধ্যে লইয়া যাইবে, সেই তোমাকে তাহার অসীম দান করিবে। কে না। জানেন, যাহাকে যত ভালোবাসা যায় সে ততই বেশি হইয়া উঠে- নহিলে প্রেমিক কেন বলিবেন, “জনম অবধি হম রূপ নেহারানু নয়ন না। তিরপিত ভেল!” একটা মানুষ যত বড়োই হউক-না কেন, তাহাকে দেখিতে কিছু বেশিক্ষণ লাগে না— কিন্তু আজন্ম কাল দেখিয়াও যখন দেখা ফুরায় না। তখন সে না-জানি কত বড়ো হইয়া উঠিয়াছে। ইহার অর্থ আর কিছুই নহে, অনুরাগের প্রভাবে প্রেমিক একজন মানুষের অন্তরস্থিত অসীমের মধ্যে প্রবেশাধিকার পাইয়াছেন, সেখানে সে মানুষের আর অন্ত পাওয়া যায় না; হৃদয় যতই দাও ততই সে গ্রহণ করে, যত দেখা ততই নতুন দেখা যায়, যত তোমার ক্ষমতা আছে ততই তুমি নিমগ্ন হইতে পাের। এইজন্যই যথার্থ অনুরাগের মধ্যে এক প্রকার ব্যাকুলতা আছে। সে এতখানি পায় যে, তাহা প্ৰাণ ভরিয়া আয়ত্ত করিতে পারে না— তাহার এত বেশি তৃপ্তি বর্তমান যে, সে তৃপ্তিকে সে সর্বতোভাবে অধিকার করিতে পারে না ও তাঁহা সুমধুর অতৃপ্তিরূপে চতুর্দিক পূর্ণ করিয়া বিরাজ করিতে থাকে। যেখানে অনুরাগ নাই সেইখানেই সীমা, সেইখানেই মহা অসীমের দ্বার রুদ্ধ, সেইখানেই চারি দিকে লীেহের ভিত্তি, কারাগার! জগৎকে যে ভালোবাসিতে শিখে নাই সে ব্যক্তি অন্ধকৃপের মধ্যে আটকা পডিয়াছে। সে মনে করিতেও পারে না। এইটুকুর বাহিরেও কিছু থাকিতে পারে। তাহার নিজের পায়ের শিকলিটার ঝমােঝম শব্দই তাহার জগতের একমাত্র সংগীত ; সে কল্পনাও কবিতে পারে না কোথাও পাখি ডাকে, কোথাও সূর্যের কিরণ বিকীরিত হয় ? অনুরাগের যে যথার্থ স্বাধীনতা তাহার একটা প্রমাণ দেওয়া যাইতে পারে। সম্পূর্ণ নূতন লোকের মধ্যে গিয়া পড়িলে আমরা যেন নিশ্বাস লাইতে পারি না, হাত পা ছড়াইতে সংকোচ হয়, যে কেহ লোক থাকে সকলেই যেন বাধার মতো বিরাজ করিতে থাকে, তাহারা সদয় ব্যবহার করিলেও সকল সময়ে মনের সংকোচ দূর হয় না। তাহার কারণ, একমাত্র অনুরাগের অভাব্যবশত আমবা তাহদের হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করিতে পাই না, যেখানে স্বাধীনতার যথার্থ বিচরণ-ভূমি সে স্থান আমাদের নিকটে রুদ্ধ। আমরা কেবলি তাহদের নাকে চোখে মুখে, আচারে ব্যবহারে, নূতন ধরনের কথায় বার্তায় হুঁচটি ঠোকর ধাক্কা খাইতে থাকি । পুরাতনের নূতনত্ব অতএব দেখা যাইতেছে জগতের সমস্ত দৃশ্যের মধ্যে অনন্ত অদৃশ্য বর্তমান। নিতানূতন-নামক যে শব্দটা কবিরা ব্যবহার করিয়া থাকেন সেটা কি নিতান্ত একটা কথার কথা, একটা আলংকারিক উক্তিমাত্র! তাহার মধ্যে গভীর সত্য আছে! অসীম যতই পুরাতন হউক-না কেন তাহার নূতনত্ব কিছুতেই ঘুচে না! সে যতই পুরাতন হইতে থাকে ততই বেশি নূতন হইতে থাকে, সে দেখিতে যতই ক্ষুদ্র হউক-না কেন প্ৰতােহই তাহাকে অত্যন্ত অধিক কবিয়া পাইতে থাকি। এই নিমিত্ত যথার্থ যে প্রেমিক সে আর নূতনের জন্য সর্বদা লালায়িত নহে, শুদ্ধ তাঁহাই নয়, পুরাতন ছাড়িয়া সে থাকিতে পারে না। কারণ, নূতন অতি ক্ষুদ্র, পুরাতন অতি বৃহৎ । পুরাতন যতই পুরাতন হইতে থাকে ততই ক্রমাগত ধাবমান হইতে থাকে, ততই জানিতে পারা যায় হৃদয়ের বিচরণক্ষেত্র অতি বৃহৎ, হৃদয়ের স্বাধীনতার কোথাও বাধা নাই। যে ব্যক্তি একবার এই পুরাতনের গভীরতার মধ্যে মগ্ন হইতে পারিয়াছে, এই সাগরের হৃদয়ে সন্তরণ করিতে পারিয়াছে, সে কি আর ছোটো ছোটাে ব্যাংগুলার আনন্দ-কল্লোল শুনিয়া প্রতারিত হইয়া নূতন নামক সংকীর্ণ কৃপটার মধ্যে আপনাকে বদ্ধ করিতে °द्र !