পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আলোচনা NR ( আজন্ম প্রত্যহ দেশের পানে চাহিয়া দেখিলে দেশ সদয় হইয়া তাহার প্রাণের মধ্যে আমাদিগকে লইয়া যান- কারণ, সকলেরই প্ৰাণ আছে। ভালোবাসিলে সকলেই তাহার প্রাণে ডাকিয়া লয় বাহা আকার-আয়তনের মধ্যে স্বাধীনতা নাই, তাহা বাধাবিপত্তিময়— আকার-আয়তনের অতীত প্ৰাণের মধ্যেই স্বাধীনতা— সেখানে পায়ে কিছু ঠেকে না, চোখে কিছু পড়ে না, শরীরে কিছুই বাধে নাকেবল এক প্রকার অনির্বাচনীয় স্বাধীনতার আনন্দ । ইহার কাছে কি আর “কেন" ঘোষিতে পারে! স্বদেশে আমাদের হৃদয়ের কী স্বাধীনতা ! স্বদেশে আমাদের কতখানি জায়গা। কারণ স্বদেশের শরীর ক্ষুদ্র, স্বদেশের হৃদয় বৃহৎ! স্বদেশের হৃদয়ে স্থান পাইয়াছি। স্বদেশের প্রত্যেক গাছপালা আমাদের চোখে ঠেকে না, আমরা একেবারেই তাহার ভিতরকার ভাব তাহার হৃদয়পূর্ণ মাধুরী দেখিতে পাই। এই সৌন্দর্য এই স্বাধীনতা সকল দেশের লোকেই সমান উপভোগ করিতে পারেন। ইহার জন্য ভূগোলবিবরণ পড়িয়া রেলোয়ের টিকিট কিনিয়া দূরদূরান্তরে যাইবার প্রয়োজন নাই। এক কাঠা জমি হইতে থাকেন। আর একদল লোক আছেন, তাহাদিগকে অভ্যাসসূত্রে কিছুতেই বাধিতে পারে না, দশ বৎসর যেখানে আছেন সেও তাহার পক্ষে যেমন আর একদিন যেখানে আছেন সেও তাহার পক্ষে তেমনি!! লোকে হয়তো বলিবে তিনিই যথার্থ দূরদশী, অপক্ষপাতী, কেবলমাত্ৰ সামান্য অভ্যাসের দরুন তাহার নিকট কোনো জিনিসের একটা মিথ্যা বিশেষত্ব প্রতীতি হয় না। বিশ্বজনীনতা তাহাতেই সম্ভবে। ঠিক উলটাে কথা। বিশ্বজনীনতা তাহতেই সম্ভাবে না। বিশ্বের প্রত্যেক বিঘা প্রত্যেক কাঠাতেই বিশ্ব বর্তমান! এক দিনে তাহা আয়ত্ত হয় না। প্রত্যহ অধিকার বাড়িতে থাকে। যিনি দশ বৎসৱে এক স্থানের কিছুই অধিকার করিতে পারিলেন না। তিনি বিশ্বকে অধিকার করিবেন কী করিয়া! বিশ্ব সর্বত্রই অসীম গভীর এবং অসীম প্রশস্ত। অতএব বিশ্বের এক কাঠা জমিকে যথার্থ ভালোবাসিতে গেলে বিশ্বজনীনতা থাকা চাই। জগৎ মিথ্যা যাহারা বলেন জগৎ মিথ্যা, তাহদের কথা এক হিসাবে সন্তা, এক হিসাবে সত্য নয়। বাহির হইতে জগৎকে যেরূপ দেখা যায় তাহা মিথ্যা। তাহার উপরে ঠিক বিশ্বাস স্থাপন করা যায় না। ঈথর কপিতেছে, আমি দেখিতেছি আলো; বাতাসে তরঙ্গ উঠিতেছে, আমি শুনিতেছি শব্দ ; ব্যবচ্ছেদবিশিষ্ট অতি সূক্ষ্মতম পরমাণুর মধ্যে আকর্ষণ বিকর্ষণ চলিতেছে, আমি দেখিতেছি বৃহৎ দৃঢ় ব্যবচ্ছেদহীন বস্তু। বস্তুবিশেষ কেনই যে বস্তুবিশেষ রূপে প্ৰতিভাত হয়, আর কিছু-রূপে হয় না, তাহার কোনো অর্থ পাওয়া যায় না। আশ্চর্য কিছুই নাই, আমাদের নিকটে যাহা বস্তুরূপে প্রতিভাত হইতেছে, আর একদল নূতন জীবের নিকটে তাহা কেবল শব্দরূপে প্রতীত হইতেছে। আমাদের কাছে বস্তু দেখা ও তাহদের কাছে শব্দ শোনা একই। এমনও আশ্চর্য নহে, আর এক নূতন জীব দৃষ্টি শ্রুতি। ঘাণ স্বাদ স্পর্শ ব্যতীত আর এক নূতন ইন্দ্ৰিয়াশক্তি-দ্বারা বস্তুকে অনুভব করে, তাহা আমাদের কল্পনার অতীত। বস্তুকে ক্ৰমাগত বিশ্লেষ করিতে গেলে তাহাকে ক্রমাগত সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মে পরিণত করা যায়— অবশেষে এমন হইয়া দাড়ায় আমাদের ভাষায় যাহার নাম নাই, আমাদের মনে যাহার ভাব নাই। মুখে বলি তাহা অসংখ্য শক্তির খেলা, কিন্তু শক্তি বলিতে আমরা কিছুই বুঝি না। অতএব, আমরা যাহা দেখিতেছি শুনিতেছি তাহার উপরে অনন্ত বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারি না। কাজের সুবিধার জন্য রাফা করিয়া কিছু দিনের মতো তাহাকে এই আকারে বিশ্বাস করিবার একটা বন্দোবস্ত হইয়াছে মাত্র; আবার অবস্থা-পরিবর্তনে এ চুক্তি ভাঙিলে তাহার জন্য আমরা কিছুমাত্র দায়িক হইব না।