পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী অপক্ষপাত জগৎ তো কাহাকেও একঘরে করে না, কাহারও ধোপা নাপিত বন্ধ করে না। চন্দ্ৰ সূৰ্য রৌদ্র বৃষ্টি, জগতের সমস্ত শক্তি সমগ্রের এবং প্রত্যেক অংশের অবিশ্রাম সমান দাসত্ব করিতেছে। তাহার কারণ এই জগতের মধ্যে যে কেহ বাস করে কেহই জগতের বিরোধী নহে। পাপী অসাধুৱা জগতের নীচের ক্লাসে পড়ে মাত্র, কিন্তু তাই বলিয়া তো তাহাদিগকে ইস্কুল হইতে তাড়াইয়া দিতে পারা যায় না। বাইবেলের অনন্ত নরক একটা সামাজিক জুজু বৈ তো আর কিছু নয়। পাপ নাকি একটা অভাব মাত্র, এই নিমিত্ত সে এত দুর্বল যে তাহাকে পিষিয়া মারিয়া ফেলিবার জন্য একটা অনন্ত জাতার আবশ্যক করে না। সমস্ত জগৎ তাহার প্রতিকূলে তাহার সমস্ত শক্তি অহৰ্নিশি প্রয়োগ করিতেছে। পাপ পুণ্যে পরিণত হইতেছে, আত্মম্ভরিতা বিশ্বম্ভরিতার দিকে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িতেছে। সকলে আত্মীয় নিতান্ত ঘূণা করিয়া আর কাহাকেও একেবারে পর মনে করা শোভা পায় না। সকলেরই মধ্যে এত ঐক্য আছে। খুঁটে মহাশয় মস্ত লোক হইতে পারেন, তাই বলিয়া যে গোবরের সঙ্গে সমস্ত আদান প্ৰদান একেবারেই বন্ধ করিয়া দিবেন। ইহা তাহার মতাে উন্নতিশীলের নিতান্ত অনুপযুক্ত কাজ । জড় ও আত্মা পূর্বেই তো বলিয়াছি আমাদের অধিকাংশই অচেতন, একটুখানি সচেতন মাত্র। তবে আর জড়িকে দেখিয়া নাসা কুঞ্চিত করা কেন ? আমরা একটা প্ৰকাণ্ড জড়ি, তাহারই মধ্যে একবত্তি চেতনা বাস করিতেছে। আত্মায় ও জডে যে বাস্তবিক জাতিগত প্ৰভেদ আছে তাহা নহে { অবস্থাগত প্ৰভেদ মাত্র } আলোক ও অন্ধকারে এতই প্ৰভেদ যে মনে হয় উভয়ে বিরোধীপক্ষ । কিন্তু বিজ্ঞান বলে, আলোকের অপেক্ষাকৃত বিশ্রামই অন্ধকার এবং অন্ধকারের অপেক্ষাকৃত উদামই আলোক। তেমনি আত্মার নিদ্ৰাই জড়িত্ব এবং জড়ের চেতনাই আত্মার ভাব } বিজ্ঞান বলে সূর্যকিরণে অন্ধকার-রশ্মিই বিস্তর, আলোক-রশ্মি তাহার তুলনায় ঢের কম; একটুখানি আলোক অনেকটা অন্ধকারের মুখপাতের স্বরূপ। তেমনি আমাদের মনেও একটুখানি চৈতন্যের সহিত অনেকখানি অচেতনতা জডিত রহিয়াছে।। জগতেও তাঁহাই।। জগৎ একটি প্রকাণ্ড গোলাকার কুঁডি, তাহার মুখের কাছটুকুতে একটুখানি চেতনা দেখা দিয়াছে। সেই মুখটুকু যদি উদ্ধত হইয়া বলে আমি মস্তলোক, জগৎ অতি নীচ, উহার সংসর্গে থাকিব না, আমি আলাদা হইয়া যাইব, তবে সে কেমনতর শোনায় ? भूJ ধর্মকে আশ্রয় করিলে মৃত্যুভয় থাকে না। এখানে মৃত্যু অর্থে ধ্বংসও নহে, মৃত্যু অর্থে অবস্থা পরিবর্তনও নহে, মৃত্য অর্থে জড়তা। অচেতনতাই অধর্ম। ধর্মকে যতই আশ্রয় করিতে থাকিব, ততই চেতনা লাভ করিতে থাকিব, ততই অনুভব করিতে থাকিব, যে মহাচৈতনো সমস্ত চরাচর অনুপ্রাণিত হইয়াছে, আমার মধ্য দিয়া এবং আমাকে প্লাবিত করিয়া সেই চৈতন্যের স্রোত প্রবাহিত হইতেছে। যথার্থ জগৎকে জ্ঞানের দ্বারা জানিবার কোনো সস্তাবনা নাই, চৈতন্য দ্বারা জানিতে হইবে। জগতের সহিত ঐক্য জগৎকে কাঠগড়ায় দাড় করাইয়া সওয়াল-জবাব করাইলে সে খুব অল্প কথাই বলে, জগতের ঘরে বাস করিলে তবে তাহার যথার্থ খবর পাওয়া যায়। তাহা হইলে জগতের হৃদয় তোমার হৃদয়ে তরঙ্গিত