পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(፩br রবীন্দ্র-রচনাবলী জাজ্জ্বল্যমান হইয়া উঠে ! আমরা কল্পনায় যেন তাহার স্পর্শ পর্যন্ত অনুভব করিতে পারি। ইহা হইতে তীর্থযাত্রার একটি প্রধান ফল অনুমান করা যায়। আমি একজন বুদ্ধের ভক্ত। বুদ্ধের অস্তিত্বের বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু যখন আমি সেই তীর্থে যাই, যেখানে বুদ্ধের দম্ভ রক্ষিত আছে, সেই শিলা দেখি যাহার উপর বুদ্ধের পদচিহ্ন অঙ্কিত আছে, তখন আমি বুদ্ধকে কতখানি প্রাপ্ত হই! যখন দেখি, ফুটন্ত, ছুটন্ত বর্তমান স্রোতের উপর পুরাতন কালের একটি প্রাচীন জীর্ণ অবশেষ নিশ্চলভাবে আছে, অতীতের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিতেছে, তখন এমন হৃদয়হীন পাষাণ কে আছে যে মুহুর্তের জন্য থামিয়া একবার পশ্চাৎ ফিরিয়া সেই মহা অতীতের দিকে চাহিয়া না দেখে! কিছুই তো থাকে না, সবই তো চলিয়া যায়, তথাপি এই যে দুটি-একটি চিহ্ন অতীত রাখিয়া গিয়াছে ইহাও মুছিয়া ফেলিতে চায়, এমন কে আছে? সময়ের অরণ্য অসীম। এই অন্ধকার অসীম মহারণ্যের মধ্য দিয়া আমরা একটি মাত্র পায়ের চিহ্ন রাখিয়া আসিতেছি, সে চিহ্ন মুছিয়া মুছিয়া আসিবার আবশ্যকটা কি ? পথের মধ্যে যে গাছের তলায় বসিয়া খেলা করিয়াছ, যে অতিথিশালায় বসিয়া আমোদপ্রমোদে বন্ধুবান্ধবদের সহিত রাত্রিযাপন করিয়াছ, একবারও কি ফিরিয়া যাইয়া সেই তরুর তলে বসিতে ইচ্ছা যাইবে না, সেই অতিথিশালার দ্বারে দাড়াইতে সাধ যাইবে না ? কিন্তু ফিরিবে: কেমন করিয়া যদি সে পথের চিহ্ন মুছিয়া ফেল! যে স্থান, যে গৃহ, যে ছায়া, যে আশ্রয় এককালে নিতান্তই তোমার ছিল তাহার অধিকার যদি একেবারে চিরকালের জন্য হারাইয়া ফেল! দেশ ও কালেই আমরা বাস করি! অথচ দেশের উপরেই আমাদের যত অনুরাগ। এক কাঠা জমির জন্য আমরা লাঠালাঠি করি, কিন্তু সুদূরবিস্তৃত সময়ের স্বত্ব অনায়াসেই ছাড়িয়া দিই, একবারও তাহার জন্য দুঃখ করি না! পুরাতন দিনের একখানি চিঠি, একটি আংটি, একটি গানের সুর, একটা যা-হয় কিছু অত্যন্ত যত্নপূর্বক রাখিয়া দেয় নাই, এমন কেহ আছে কি? যাহার জ্যোৎস্নার মধ্যে পুরাতন দিনের জ্যোৎস্না, যাহার বর্ষার মধ্যে পুরাতন দিনের মেঘ লুকায়িত নাই, এত বড়ো অপৌত্তলিক কেহ আছে কি ! পৌত্তলিকতার কথা বলিলাম, কেননা প্ৰত্যক্ষ দেখিয়া অপ্রত্যক্ষকে মনে আনাই পৌত্তলিকতা। জগৎকে দেখিয়া জগতাতীতকে মনে আনা পৌত্তলিকতা। একটি চিঠি দেখিয়া যদি আমার অতীতকালের কথা মনে পড়ে তবে তাহা পৌত্তলিকতা নহে তো কি ? ঐ চিঠিটুকু আমার অতীত কালের প্রতিমা। উহার কোনো মূল্য নাই, কেবল উহার মধ্যে আমার অতীতকাল প্রতিষ্ঠিত আছে বলিয়াই উহার এত সমাদর। জিজ্ঞাসা করিতেছিলাম, এমন কোনো লোক কি আছে যে তাহার পুরাতন দিবসের একটা কোনো চিহ্নও রাখিয়া দেয় নাই ? আছে বৈকি! তাহারা অত্যন্ত কাজের লোক, তাহারা অতিশয় জ্ঞানী লোক! তাহদের কিছুমাত্র কুসংস্কার নাই। যতটুকু দরকার আছে কেবল মাত্র ততটুকুকেই তাহারা খাতির করে। বোধ করি দশ বৎসর পর্যন্ত তাহারা মা-কে মা বলে, তাহার পর তার নাম ধরিয়া ডাকে। কারণ, সন্তানপালনের জন্য যত দিন মায়ের বিশেষ আবশ্যক তত দিনই তিনি মা, তাহার পর অন্য বুদ্ধার সহিত তাহার তফাত কী ? আমি যে সম্প্রদায়ের কথা বলিতেছি তাহারা যে সত্য-সত্যই বয়স হইলে মাকে মা বলেন না। তাহা নহে। অনাবশ্যক মাকেও ইহারা মা বলিয়া আদর করিয়া থাকেন। কিন্তু অতীত মাতার প্রতি ইহাদের ব্যবহার স্বতন্ত্র। মায়ের কাছ হইতে ইহারা যাহা-কিছু পাইয়াছেন, অতীতের কাছ হইতে তাহা অপেক্ষা অনাবশ্যক যাহা-কিছু, তাহা সমস্তই ইহারা কেন কুসংস্কার বলিয়া একেবারে বঁাটাইয়া ফেলিতে চান ? তাহারা ইহা বুঝেন না, শুষ্ক জ্ঞানের চক্ষে সমস্ত আবশ্যক অনাবশ্যক ধরা পড়ে না। আমাদের আচারব্যবহারে কতকগুলি চিরন্তন প্ৰথা প্ৰচলিত আছে, সেগুলি ভালোও নয় মন্দও নয়, কেবল দোষের মধ্যে তাহারা অনাবশ্যক- তাহদের দেখিয়া কঠোর জ্ঞানবান লোকের মুখে হাসি আসে এই ছুতায় তুমি তাহাদিগকে পরিত্যাগ করিলে। মনে করিলে, তুমি কতকগুলি অর্থহীন অনাবশ্যক