পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমালোচনা هوما কিন্তু প্ৰভেদ জানা যায় কী কবিয়া ? উপায় আছে। যিনি সৃজন করেন, তিনি আপনাকেই নানা আকারে ব্যক্তি করেন। তিনি নিজেকেই কখনো-বা। রামরূপে, কখনো-বা। রাবণরূপে, কখনো-বা হ্যামলেটরূপে, কখনো-বা ম্যাকবেথরূপে পরিণত করিতে পারেন— সুতরাং অবস্থাবিভেদে প্রকৃতিবিভেদ প্রকাশ করিতে পারেন। আর যিনি গড়েন। তিনি পরকে গড়েন, সুতরাং তার একচুল এদিক ওদিক করিবার ক্ষমতা নাই- ইহতদের কেবল কেরানিগিরি করিতে হয়, পাকা হাতে পাকা অক্ষর লিখেন, কিন্তু অনুস্বর বিসর্গ নাড়াচাড়া করিতে ভরসা হয় না! আমাদের শাস্ত্ৰ ঈশ্বরকে কবি বলেন, কারণ, আমাদের ব্ৰহ্মবাদীরা অদ্বৈতবাদী। এইজন্যই তাহারা বলেন, ঈশ্বর কিছুই গঠিত করেন নাই, ঈশ্বর নিজেকেই সৃষ্টিরূপে বিকশিত করিয়াছেন। কবিদেরও তাঁহাই কাজ, সৃষ্টির অর্থই তাঁহাই ; একটা দুষ্টান্ত দেওয়া যাক। আমরা যতগুলি ট্রাজেডি দেখিয়াছি সকলগুলিতেই প্ৰায় শেষকালে একটা না একটা মৃত্যু আছে। তাহা হইতেই সাধারণত লোকে সিদ্ধান্ত কবিয়া রাখিয়াছে, শেষকালে মরণ না থাকিলে আর ট্র্যাজেডি হয় না ! শেষকালে মিলন হইলেই আর ট্র্যাজেডি হইল না। পাত্ৰগণের মিলন অথবা মরণ, সে তো কাবোর বাহা আকার মাত্র, তাহাই লইয়া কাব্যের শ্রেণী নির্দেশ করিতে যাওয়া দূরদর্শীর লক্ষণ নহে। যে অনিবার্য নিয়মে সেই মিলন বা মরণ সংঘটিত হইল, তাহারই প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে হইবে ; মহাভারতের অপেক্ষা মহান ট্র্যাজেডি কে কোথায় দেখিয়াছ ? স্বৰ্গারোহণকালে দ্ৰৌপদী ও ভীমাৰ্জন প্রভূতির মৃত্যু হইয়াছিল বলিয়াই যে মহাভারত ট্রাজেডি তাহা নহে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্ম কৰ্ণ দ্ৰোণ এবং শত সহস্র রাজা ও সৈন্য মরিয়াছিল বলিয়াই যে মহাভারত ট্রাজেডি তাহা নহে— কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যখন পাণ্ডবদিগের জয় হইল তখনি মহাভারতের যথার্থ ট্রাজেডি আরম্ভ হইল। তােহাৱা দেখিলেন জয়ের মধ্যেই পরাজয় । এত দুঃখ, এত যুদ্ধ, এত বক্তপাতের পর দেখিলেন হাতে পাইযা কোনো সুখ নাই, পাইবার জন্য উদ্যমেই সমস্ত সুখ; যতটা করিয়াছেন তাহার তুলনায় যাহা পাইলেন তােহা অতি সামানা ; এত দিন যুঝাযুঝি কবিয়া হৃদয়ের মধ্যে একটা বেগবান অনিবার উদ্যামের সৃষ্টি হইয়াছে, যখনই ফল লাভ হইল। তখনই সে উদ্যামের কার্যক্ষেত্ৰ মরুময় হইয়া গেল, হৃদয়ের মধ্যে সেই দুৰ্ভিক্ষপীডিত উদ্যামের হাহাকার উঠিতে লাগিল; কয়েক হস্ত জমি মিলিল বটে, কিন্তু হৃদয়ের দাড়াইবার স্থান তাহাব পদতল হইতে ধসিয়া গেল, বিশাল জগতে এমন স্থান সে দেখিতে পাইল না যেখানে সে তাহার উপাৰ্জিত উদাম নিক্ষেপ করিয়া সুস্থ হইতে পাকে । ইহাকেই বলে ট্রাজেডি। আৰো নাবিয়া আসা যাক, ঘরের কাছে একটা উদাহরণ মিলিবে! সৰ্যমুখীর সহিত নগেন্দ্ৰেৰ শেষকালে মিলন হইয়া গেল বলিয়াই কি বিষবৃক্ষ ট্রাজেডি নহে? সেই মিলনের মধ্যেই কি চিবকালের জন্য একটা অভিশাপ জড়িত হইয়া গেল না ? যখন মিলনের মুখে হাসি নাই, যখন মিলনের বুক ফাটিয়া যাইতেছে, যখন উৎসবের কোলের উপরে শোকের কঙ্কাল, তখন তাহার অপেক্ষ অব ট্র্যাজেডি কী আছে ? কুন্দনন্দিনীক সমস্ত শেষ হইয়া গেল বলিয়া বিষবৃক্ষ ট্রাজেডি নাহে— কুন্দনন্দিনী তো এ ট্রাজেডির উপলক্ষ মাত্র। নগেন্দ্র ও সূর্যমুখীর মিলনের বুকের মধ্যে কুন্দনন্দিনীর মৃত্যু চিরকাল বাচিয়া রহিল— মিলনের সহিত বিয়োগের চিরস্থায়ী বিবাহ হইল:- আমরা বিষবৃক্ষের শেষে এই নিদারুণ অশুভ বিবাহের প্রথম বাসরের রাত্ৰি মাত্ৰ দেখিতে পাইলামবাকিটুকু কেবল চোখ বুজিয়া ভাবিলাম— ইহাই ট্র্যাজেডি! অনেকে জানেন না, সমস্তটা নিকাশ করিয়া ফেলিলে অনেক সময় ট্রাজেডির ব্যাঘাত হয়। অনেক সময় সেমিকেলনে যতটা ট্রাজেডি থাকে দাড়িতে ততটা থাকে না ; কিন্তু যাহারা না বুঝিয়া ট্রাজেডি লিখিতে যান তাহারা কাব্যের আরম্ভ হইতেই বিষ ফরমাস দেন, ছুরি শানাইতে থাকেন, ও চিতা সাজাইতে শুরু করেন। এপিক (epic) শব্দটা লইয়াও এইরূপ গোলযোগ হইয়া থাকে। এপিক বলিতে লোকে সাধারণত বুঝিয়া থাকে একটা মারামারি কাটাকাটির ব্যাপার! যাহাতে যুদ্ধ নাই তাহার আর এপিক হইবে কী করিয়া ? আমরা যতগুলি বিখ্যাত এপিক দেখিয়াছি তাহার প্রায় সবগুলিতেই যুদ্ধ আছে সন্তা কিন্তু