পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ñ R রবীন্দ্র-রচনাবলী তাহা তো সামান্য, কিন্তু রাধা। যা কহিল না। তাহা কতখানি!! যাহা বলা হইল না পাঠকদিগকে তাহাই শুনিতে হইবে! শ্যামকে ভিজিতে দেখিয়া রাধার দুঃখ ও শ্যামকে ভিজিতে দেখিয়াই রাধার সুখ, উভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব হইতেছে। রাধার হৃদয়ের এই তরঙ্গভঙ্গ, এই উৎখানপতন, কত অল্প কথায় কত সুন্দরীরূপে ব্যক্ত হইয়াছে! প্ৰথম দুই ছত্রে শ্যামকে দেখিয়া দুঃখ, দ্বিতীয় দুই ছত্ৰে সুখ, তৃতীয় দুই ছত্রে আবার দুঃখ, চতুর্থ দুই ছত্রে আবার সুখ। রাধা হাসিবে কি কাদিবে ভাবিয়া পাইতেছে না। রাধা সুখে দুঃখে আকুল হইয়া পড়িয়াছে। শেষে রাধা এই মীমাংসা করিল, শ্যাম আমার জন্য কত কষ্ট পাইয়াছে, আমি শ্যামের জন্য ততোধিক কষ্ট স্বীকার করিয়া শ্যামের সে ঋণ পরিশোধ করিব। দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত। — সই, কেমনে ধরিব হিয়া ? আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায় আমার আঙ্গিনা দিয়া ! সে বধু কালিয়া না চায় ফিরিয়া, এমতি করিল কে ? তেমনি হউক সে ? যাহার লাগিয়া সব তেয়াগিনু, লোকে অপযশ কয়, সেই গুণনিধি ছাড়িয়া পিরীতি আর জানি কার হয়! এমতি করিল কে ? আমার পরাণ যেমতি করিছে। সেমিতি হউক সে ! “আমার পরাণ যেমতি করিছে তেমতি হউক সে!” এই কথাটার মধ্যে কতটা কথা আছে। রাধা সমস্ত বিশ্ব-ব্ৰহ্মাণ্ডে আর অভিশাপ খুজিয়া পাইল না। শত সহস্র অভিশাপের পরিবর্তে সে কেবল একটি কথা কহিল। সে কহিল, “আমার পরাণ যেমন করিছে, তেমনি হউক সে!” ইহাতেই বুঝিতে পারিয়াছি রাধার পরান কেমন করিতেছে! ঐ এক “যেমন করিছে” শব্দের মধ্যে নিদারুণ কষ্ট প্রচ্ছন্ন আছে, সে কষ্ট বর্ণনা না করিলে যতটা বর্ণিত হয় এমন আর কিছুতে না। উপরি-উক্ত পদটির মধ্যে রাধা দুই বার অভিশাপ দিতে গিয়াছে, কিন্তু উহার অপেক্ষা গুরুতর অভিশাপ সে আর কোনোমতে খুজিয়া পাইল না। ইহাতেই রাধার সমস্ত হৃদয় দেখিতে পাইলাম। বিদ্যাপতি সুখের কবি, চণ্ডিদাস দুঃখের কবি। বিদ্যাপতি বিরহে কাতর হইয়া পড়েন, চণ্ডিদাসের মিলনেও সুখ নাই। বিদ্যাপতি জগতের মধ্যে প্রেমকে সার বলিয়া জানিয়াছেন, চণ্ডিদাস প্রেমকেই জগৎ বলিয়া জানিয়াছেন। বিদ্যাপতি ভোগ করিবার কবি, চণ্ডিদাস সহ্য করিবার কবি! চণ্ডিদাস সুখের মধ্যে দুঃখ ও দুঃখের মধ্যে সুখ দেখিতে পাইয়াছেন। তাহার সুখের মধ্যেও ভয় এবং দুঃখের প্রতিও অনুরাগ। বিদ্যাপতি কেবল জানেন যে মিলনে সুখ ও বিরহে দুঃখ, কিন্তু চণ্ডিদাসের হৃদয় আরো গভীর, তিনি উহা অপেক্ষা আরো অধিক জানেন! তাহার প্ৰেম “কিছু কিছু সুধা বিষগুণা আধা”, তাহার কাছে শ্যাম যে মুরলী বাজান তাহাও “বিষামৃতে একত্র করিয়া”।-- কহে চণ্ডিদাস, ‘শুনি বিনোদিনী, সুখ দুখ দুটি ভাই, সুখের লাগিয়া যে করে পিরীতি, দুখ যায় তার ঠাই।'