পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

তিন সঙ্গী २¢S মনে-মনে উপভোগ করেছেন। এর চেয়ে বেড়। আর অল্প-একটু যদি ডিঙোতুম, তা হলে— তা হলে কী হ’ত কী জানি । রাগতেন, না রাগের ভান করতেন ? অত্যন্ত চঞ্চল মন নিয়ে চলেছি আমার বাংলো ঘরের পথে, এমন সময় আমার চোখে পড়ল দুই টুকরায় ছিন্নকরা একখানা চিঠির খাম। এটাকে জিয়লজিকাল নমুনা বলে না। তবু তুলে দেখলুম। নামটা ভবতোষ মজুমদার আই. সি. এস. ; ঠিকানা ছাপরা, মেয়েলি হাতে লেখা। টিকিট লাগানো আছে, তাতে ডাকঘরের ছাপ নেই। যেন কুমারীর দ্বিধা । আমার বিজ্ঞানী বুদ্ধি ; স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, এই ছেড়া চিঠির খামের মধ্যে একটা ট্র্যাজেডির ক্ষতচিহ্ন আছে। পৃথিবীর ছেড়া স্তর থেকে তার বিপ্লবের ইতিহাস বের করা আমাদের কাজ। সেই আমার সন্ধানপটু হাত এই ছেড়া খামের রহস্য আবিষ্কার করতে সংকল্প করলে । ইতিমধ্যে ভাবছি, নিজের অন্তঃকরণের রহস্ত অভূতপূর্ব। এক-একটা বিশেষ অবজ্ঞার সংস্পর্শে তার ভাবখান কী যে একটা নতুন আকারে দান বেঁধে দেখা দেয়, এবারে তার পরিচয়ে বিস্মিত হয়েছি। এতদিন যে-মনটা নানা কঠিন অধ্যবসায় নিয়ে শহরে শহরে জীবনের লক্ষ্য সন্ধানে ঘুরেছে, তাকে স্পষ্ট করে চিনেছিলুম। ভেবেছিলুম সেই আমার সত্যকার স্বভাব, তার আচরণের ধ্রুবত্ব সম্বন্ধে আমি হলপ করতে পারতুম। কিন্তু তার মধ্যে বুদ্ধিশাসনের বহির্ভূত যে-একটা মূঢ় লুকিয়ে ছিল, তাকে এই প্রথম দেখা গেল। ধরা পড়ে গেল আরণ্যক, যে যুক্তি মানে না, যে মোহ মানে । বনের একটা মায়া আছে, গাছপালার নিঃশব্দ চক্রান্ত, আদিম প্রাণের মন্ত্রধ্বনি । দিনে দুপুরে ঝ ঝণ করে তার উদাত্ত স্বর, রাতে দুপুরে মন্দ্ৰগম্ভীর ধ্বনি, গুঞ্জন করতে থাকে জীব-চেতনায়, আদিম প্রাণের গৃঢ় প্রেরণায় বুদ্ধিকে দেয় আবিষ্ট করে। জিয়লজির চর্চার মধ্যেই ভিতরে ভিতরে এই অরণ্যক মায়ার কাজ চলছিল, খুজছিলুম রেডিয়মের কণা, যদি কৃপণ পাথরের মুঠির মধ্য থেকে বের করা যায় ; দেখতে পেলুম অচিরাকে, কুমুমিত শালগাছের ছায়ালোকের বন্ধনে। এর পূর্বে বাঙালি মেয়েকে দেখেছি সন্দেহ নেই। কিন্তু সবকিছু থেকে স্বতন্ত্র ভাবে এমন একান্ত করে তাকে দেখবার স্থযোগ পাই নি। এখানে তার স্যামল দেহের কোমলতায় বনের লতাপাত আপন ভাষা যোগ করে দিল । বিদেশিনী রূপসী তো অনেক দেখেছি, যথোচিত ভালোও লেগেছে। কিন্তু বাঙালি মেয়ে এই যেন প্রথম দেখলুম, ঠিক যেজায়গায় তাকে সম্পূর্ণ দেখা যেতে পারে, এই নিভৃত বনের মধ্যে সে নানা পরিচিতঅপরিচিত বাস্তবের সঙ্গে জড়িয়ে মিশিয়ে নেই ; দেখে মনে হয় না, সে বেণী দুলিয়ে ডায়োসিশনে পড়তে যায়, কিংবা বেথুন কলেজের ডিগ্রিধারিণী, কিংবা বালিগঞ্জের