পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१९२ ।। রবীন্দ্র-রচনাবলী টুকরোয় ছিন্নকর একখানা চিঠির খাম। তাতে নাম লেখা, ভবতোষ মজুমদার আই. পি. এস, ছাপরা। তার বিশেষত্ব এই ষে, এতে টিকিট আছে, কিন্তু সে টিকিটে ডাকঘরের ছাপ নেই। বুঝতে পারলুম ছেড়া চিঠির খামের মধ্যে একটা ট্র্যাজেডির ক্ষতচিহ্ন আছে। পৃথিবীর ছেড়া স্তর থেকে তার বিপ্লবের ইতিহাস বের করা আমার কাজ। সেই রকম কাজে লাগলুম ছেড়া খামটা নিয়ে। 审 ইতিমধ্যে ভাবনা ধরিয়ে দিয়েছে আমার নিজের অন্তঃকরণটা। নিজের অপ্ৰমত্ত কঠিন মনটাকে চিনে নিয়েছি বলে স্পষ্ট ধারণা ছিল। আজ এই প্রথম দেখলুম তার পাশের পাড়াতেই লুকিয়ে বসে আছে বুদ্ধিশাসনের বহিভূত একটা অবোধ । নির্জন অরণ্যের সুগভীর কেন্দ্রস্থলে একটা স্বনিবিড় সম্মোহন আছে যেখানে চলছে তার বুড়ো বুড়ে গাছপালার কানে কানে চক্রাস্ত, যেখানে ভিতরে ভিতরে উচ্ছসিত হচ্ছে স্বাক্টর আদিম প্রাণের মন্ত্রগুঞ্জরণ। দিনে দুপুরে ঝ ঝণ করে ওঠে তার স্থর উদাত্ত পর্দায়, রাতে দুপুরে তার মন্ত্ৰগম্ভীর ধ্বনি স্পদিত হতে থাকে জীবচেতনায়, বুদ্ধিকে দেয় আবিষ্ট করে। জিয়লজি-চর্চার ভিতরে ভিতরেই মনের আস্তর্ভৌম প্রদেশে ব্যাপ্ত হচ্ছিল এই আরণ্যক মায়ার কাজ । হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে উঠে সে এক মুহূর্তে আমার দেহমনকে আবিষ্ট করে দিল যখনই দেখলুম অচিরাকে কুস্থমিত ছায়ালোকের পরিবেষ্টনে । বাঙালি মেয়েকে ইতিপূর্বে দেখেছি সন্দেহ নেই। কিন্তু তাকে এমন বিশুদ্ধ স্বপ্রকাশ স্বাতন্ত্র্যে দেখি নি। লোকালয়ে যদি এই মেয়েটিকে দেখতুম তা হলে যাকে দেখা যেত নানা লোকের সঙ্গে নানা সম্বন্ধে জড়িত বিমিশ্রিত এ মেয়ে সে নয়, এ দেখা দিল পরিবিস্তৃত নির্জন সবুজ নিবিড়তার পরিপ্রেক্ষিতে একান্ত স্বকীয়তায় । মনে হল না বেণী দুলিয়ে এ কোনো কালে ডায়োসিশনে পর্সেণ্টেজ রাখতে গেছে, শাড়ির উপরে গাউন ঝুলিয়ে ডিগ্রি নিতে গেছে কনভোকেশনে, বালিগঞ্জে টেনিস-পার্টতে চা ঢালছে উচ্চ কলহাস্তে। অল্পবয়সে শুনেছি পুরোনো বাংলা গান– “মনে রইল সই মনের বেদনা”— তারই সরল স্বরের সঙ্গে মিশিয়ে চিরকালের বাঙালি মেয়ের একটা করুণ চেহার। আমি দেখতে পেতুম, অচিরাকে দেখে মনে হল সেইরকম বারোয়। গানে তৈরি বাণীমূর্তি, যে গান রেডিয়োতে বাজে না, গ্রামোফোনে পাড়া মুখর করে ন। এদিকে আমার আপনার মধ্যে দেখলুম মনের নিচের তলাকার তপ্তবিগলিত একটা প্রদীপ্ত রহস্য হঠাৎ উপরের আলোতে উদগীর্ণ হয়ে উঠেছে। , বুঝতে পারছি আমি যখন রোজ বিকেলে এই পথ দিয়ে কাজে ফিরেছি অচিরা আমাকে দেখেছে, অন্তমনস্ক আমি ওঁকে দেখি নি। নিজের চেহারা সম্বন্ধে যে বিশ্বাস