পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি २२१ তাহাদের সকলের চেয়ে রমেশের উপরেই এমন অসন্দিগ্ধ বিশ্বাসে যোগেন্দ্র রাগ করিল। সাবধানে ভূমিকা করিয়া কথা পাড়া আর চলিল না। যোগেন্দ্র কঠিনভাবে বলিতে লাগিল, “তোমার তো মনে আছে, রমেশ মাস-ছয়েক জাগে তাহার বাপের সঙ্গে দেশে চলিয়া গিয়াছিল। তাহার পরে অনেক দিন তাহার কোনো চিঠিপত্র না পাইয়া আশ্চর্য হইয়া গিয়াছিলাম। ইহাও তুমি জান যে, যে রমেশ দুই বেলা আমাদের এখানে আসিত, যে বরাবর আমাদের পাশের বাড়িতে বাসা লইয়া ছিল, সে কলিকাতায় আসিয়া আমাদের সঙ্গে একবারও দেখাও করিল না, অন্ত বাসায় গিয়া গা-ঢাকা দিয়া রহিল— ইহা সত্ত্বেও তোমরা সকলে পূর্বের মতো বিশ্বাসেই তাহাকে ঘরে ডাকিয়া আনিলে ! আমি থাকিলে এমন কি কখনো ঘটিতে পারিত ?” হেমনলিনী চুপ করিয়া রহিল। যোগেন্দ্র। রমেশের এইরূপ ব্যবহারের কোনো অর্থ তোমরা খুজিয়া পাইয়াছ ? এ সম্বন্ধে একটা প্রশ্নও কি তোমাদের মনে উদয় হয় নাই ? রমেশের পরে এত গভীর বিশ্বাস ! হেমনলিনী নিরুত্তর । যোগেন্দ্র । আচ্ছা, বেশ কথা— তোমরা সরলস্বভাব, কাহাকেও সন্দেহ কর না— আশা করি, আমার উপরেও তোমার কতকটা বিশ্বাস আছে। আমি নিজে ইস্কুলে গিয়া খবর লইয়াছি, রমেশ তাহার স্ত্রী কমলাকে সেখানে বোর্ডার রাখিয়া পড়াইতেছিল। ছুটির সময়েও তাহাকে সেখানে রাখিবার বন্দোবস্ত করিয়াছিল। হঠাৎ দুই-তিন দিন হইল, ইস্কুলের কত্রীর নিকট হইতে রমেশ চিঠি পাইয়াছে যে, ছুটির সময়ে কমলাকে ইস্কুলে রাখা হইবে না। আজ তাহদের ছুটি ফুরাইয়াছে – কমলাকে ইস্কুলের গাড়ি দরজিপাড়ায় তাহাদের সাবেক বাসায় পৌছাইয়া দিয়াছে। সেই বাসায় আমি নিজে গিয়াছি। গিয়া দেখিলাম, কমলা বঁটিতে আপেলের খোসা ছাড়াইয়া কাটিয়া দিতেছে, রমেশ তাহার স্বমুখে মাটিতে বসিয়া এক-এক টুকরা লইয়া মুখে পুরিতেছে । রমেশকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ব্যাপারখানা কী ? রমেশ বলিল, সে এখন আমাদের কাছে কিছুই বলিবে না। যদি রমেশ একটা কথাও বলিত ষে, কমলা তাহার স্ত্রী নয়, তা হলেও নাহয় সেই কথাটুকুর উপর নির্ভর করিয়া কোনোমতে সন্দেহকে শাস্ত করিয়া রাখিবার চেষ্টা করা যাইত। কিন্তু সে হা-না কিছুই বলিতে চায় না। এখন, ইহার পরেও কি রমেশের উপর বিশ্বাস রাখিতে চাও ? প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় যোগেন্দ্র হেমনলিনীর মুখের প্রতি নিরীক্ষণ করিয়া দেখিল, তাহার মুখ অস্বাভাবিক বিবর্ণ হইয়া গেছে, এবং তাহার যতটা জোর আছে,