পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৫৬ রবীন্দ্র-রচনাবলী কমলা জিজ্ঞাসা করিল, “এ-সমস্ত কোথা হইতে আনিলি ?” উমেশ সংগ্রহের যাহা ইতিহাস দিল তাহা কিছুমাত্র সন্তোষজনক নহে। গতকল্য বাজার হইতে দধি প্রভৃতি কিনিতে যাইবার সময় সে গ্রামস্থ কাহারও বা চালে কাহারও বা খেতে এই-সমস্ত ভোজ্যপদার্থ লক্ষ্য করিয়াছিল। আজ ভোরে জাহাজ ছাড়িবার পূর্বে তীরে নামিয়া এইগুলি যথাস্থান হইতে চয়ন-নির্বাচনে প্রবৃত্ত হইয়াছিল, কাহারও সম্মতির অপেক্ষ রাখে নাই । রমেশ অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, “পরের থেত হইতে তুই এই-সমস্ত চুরি করিয়া আনিয়াছিস ?” উমেশ কহিল, "চুরি করিব কেন ? খেতে কত ছিল, আমি অল্প এই ক'টি জানিয়াছি বৈ তো নয়, ইহাতে ক্ষতি কী হইয়াছে ?” রমেশ । অল্প আনিলে চুরি হয় না ? লক্ষ্মীছাড়া ! যা, এ-সমস্ত এখান থেকে লইয়া যা । উমেশ করুণনেত্ৰে এক বার কমলার মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “মা, এইগুলিকে আমাদের দেশে পিড়িং শাক বলে, ইহার চচ্চড়ি বড়ো সরেস হয় । আর এইগুলো বেতো শাক —” রমেশ দ্বিগুণ বিরক্ত হইয়া কহিল, “নিয়ে যা তোর পিড়িং শাক । নহিলে আমি সমস্ত নদীর জলে ফেলিয়া দিব ।” এ সম্বন্ধে কর্তব্যনিরূপণের জন্য সে কমলার মুখের দিকে চাহিল। কমলা লইয়৷ যাইবার জন্য সংকেত করিল। সেই সংকেতের মধ্যে করুণামিশ্রিত গোপন প্রসন্নতা দেখিয়া উমেশ শাকসজিগুলি কুড়াইয়া চুপড়ির মধ্যে লইয়া ধীরে ধীরে প্রস্থান করিল। রমেশ কহিল, “এ ভারি অন্যায়। ছেলেটাকে তুমি প্রশ্রয় দিয়ে না।” রমেশ চিঠিপত্র লিখিবার জন্য তাহার কামরায় চলিয়া গেল। কমলা মুখ বাড়াইয়া দেখিল, সেকেণ্ড, ক্লাসের ডেক পারাইয়া জাহাজের হালের দিকে যেখানে তাহাদের দরম-ঢাকা রান্নার স্থান নির্দিষ্ট হইয়াছে সেইখানে উমেশ চুপ করিয়া বসিয়া আছে। • সেকেণ্ড ক্লাসে যাত্রী কেহ ছিল না। কমলা মাথায় গায়ে একটা র্যাপার জড়াইয়া উমেশের কাছে গিয়া কহিল, “সেগুলো সব ফেলিয়া দিয়াছিস নাকি ?” উমেশ কহিল, “ফেলিতে যাইব কেন ? এই ঘরের মধ্যেই সব রাখিয়াছি।” কমলা রাগিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, “কিন্তু তুই ভারি অন্যায় করিয়াছিল। আর কখনো এমন কাজ করিস নে। দেখ, দেখি স্টীমার যদি চলিয়া যাইত !” এই বলিয়া ঘরের মধ্যে গিয়া কমলা উদ্ধতস্বরে কহিল, “জ্ঞান, বট জান।”