পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি Հ«:» মন্দীভূত রৌদ্র ঝিকমিক্‌ করিতেছে। নদীর দুই তীরে নবীনশুমে শারদশস্তক্ষেত্রের মাঝখানকার সংকীর্ণ পথ দিয়া গ্রামরমণীরা গা ধুইবার জন্য ঘট কক্ষে করিয়া চলিয়া আসিত্তেছে । . কমলা পান সাজ শেষ করিয়া, চুল বাধিয়া, মুখ-হাত ধুইয়া, কাপড় ছাড়িয়া সন্ধ্যার জন্য যখন প্রস্তুত হইয়া লইল, সূর্য তখন গ্রামের বঁাশবনগুলির পশ্চাতে অস্ত গিয়াছে। জাহাজ সেদিনকার মতো স্টেশন-ঘাটে নোঙর ফেলিয়াছে। আজ কমলার রাত্রের রন্ধনব্যাপার তেমন বেশি নহে। সকালের অনেক তরকারি এ বেলা কাজে লাগিবে। এমন সময় রমেশ আসিয়া কহিল, মধ্যাহ্নে আজ শুরুভোজন হইয়াছে, এ বেলা সে আহার করিবে না। কমলা বিমৰ্ষ হইয়া কহিল, “কিছু খাইবে না ? শুধু কেবল মাছ-ভাজা দিয়া—” রমেশ সংক্ষেপে কহিল, “না, মাছ-ভাজ থাক।” বলিয়া চলিয়া গেল । কমলা তখন উমেশের পাতে সমস্ত মাছ-ভাজা ও চচ্চড়ি উজাড় করিয়া ঢালিয়া দিল । উমেশ কহিল, “তোমার জন্য কিছু রাখিলে না ?” সে কহিল, “আমার খাওয়া হইয়া গেছে।” এইরূপে কমলার এই ভাসমান ক্ষুদ্র সংসারের এক দিনের সমস্ত কর্তব্য সম্পন্ন হইয়া গেল । জ্যোংস্কা তখন জলে স্থলে ফুটিয়া উঠিয়াছে। তীরে গ্রাম নাই, ধানের খেতের ঘন-কোমল স্থবিস্তীর্ণ সবুজ জনশূন্ততার উপরে নিঃশব্দ শুভ্ররাত্রি বিরহিণীর মতো জাগিয়া রহিয়াছে। তীরে টিনের-ছাদ-দেওয়া যে ক্ষুদ্র কুটিরে স্টীমার-আপিস সেইখানে একটি শীর্ণদেহ কেরানি টুলের উপরে বসিয়া ডেস্কের উপর ছোটো কেরোসিনের বাতি লইয়া খাত। লিখিতেছিল। খোলা দরজার ভিতর দিয়া রমেশ সেই কেরানিটিকে দেখিতে পাইতেছিল। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া রমেশ ভাবিতেছিল, ‘আমার ভাগ্য যদি আমাকে ওই কেরানিটির মতো একটি সংকীর্ণ অথচ সুস্পষ্ট জীবনযাত্রার মধ্যে বাধিয়া দিত- হিসাব লিখিতাম, কাজ করিতাম, কাজে ক্রটি হইলে প্রভূর বকুনি খাইতাম, কাজ সারিয়া রাত্রে বাসায় যাইতাম – তবে আমি বাচিতাম, আমি বাচিতাম ।’ ক্রমে আপিস ঘরের আলো নিবিয়া গেল। কেরানি ঘরে তালা বন্ধ করিয়া হিমের ভয়ে মাথায় র্যাপার মুড়ি দিয়া নির্জন শস্তক্ষেত্রের মাঝখান দিয়া ধীরে ধীরে কোন দিকে চলিয়া গেল, আর দেখা গেল না । কমলা ষে অনেকক্ষণ ধরিয়া চুপ করিয়া জাহাজের রেল ধরিয়া পশ্চাতে দাড়াইয়া