পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি ఇఅS রাত্রি আর কাটে না। পাশের ঘরে রমেশ এতক্ষণে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। বিছানার মধ্যে কমলা আর থাকিতে পারিল না। আস্তে আস্তে বাহিরে চলিয়া আসিল । জাহাজের রেলিং, ধরিয়া তীরের দিকে চাহিয়া রহিল। কোথাও জনপ্রাণীর সাড়াশব্দ নাই— চাদ পশ্চিমের দিকে নামিয়া পড়িতেছে। দুই ধারের শস্তক্ষেত্রের মাঝখান দিয়া যে সংকীর্ণ পথ অদৃগু হইয়া গেছে, সেই দিকে চাহিয়া কমল ভাবিতে লাগিল— এই পথ দিয়া কত মেয়ে জল লইয়া প্রত্যহ আপন ঘরে যায়। ঘর : ঘর বলিতেই তাহার প্রাণ যেন বুকের বাহিরে ছুটিয়া আসিতে চাহিল। একটুখানি মাত্র ঘর— কিন্তু সে ঘর কোথায় ! শূন্ত তীর ধুধু করিতেছে, প্রকাও আকাশ দিগন্ত হইতে দিগন্ত পর্যন্ত স্তন্ধ । অনাবশ্বক আকাশ, অনাবশ্যক পৃথিবী— ক্ষুদ্র বালিকার পক্ষে এই অস্তহীন বিশালত অপরিসীম অনাবশ্বক – কেবল তাহার একটিমাত্র ঘরের প্রয়োজন ছিল । এমন সময় হঠাৎ কমলা চমকিয়া উঠিল— কে এক জন তাহার অনতিদূরে দাড়াইয়া আছে। “ভয় নাই মা, আমি উমেশ । রাত ষে অনেক হইয়াছে, ঘুম নাই কেন ?” এতক্ষণ যে অশ্র পড়ে নাই, দেখিতে দেখিতে দুই চক্ষু দিয়া সেই অশ্র উছলিয়া পড়িল । বড়ে বড়ো ফোটা কিছুতে বাধা মানিল না, কেবলই ঝরিয়া পড়িতে লাগিল । ঘাড় বাকাইয়া কমলা উমেশের দিক হইতে মুখ ফিরাইয়া লইল । জলভার বহিয়া মেঘ ভাসিয়া যাইতেছে— যেমনি তাহারই মতো আর-একটা গৃহহার হাওয়ার স্পর্শ লাগে অমনি সমস্ত জলের বোঝা ঝরিয়া পড়ে ; এই গৃহহীন দরিদ্র বালকটার কাছ হইতে একটা যত্বের কথা শুনিবামাত্র কমলা আপনার বুক-ভরা অশ্রুর ভার আর রাখিতে পারিল না। একটা-কোনো কথা বলিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু রুদ্ধ কণ্ঠ দিয়া কথা বাহির হইল না । পীড়িতচিত্ত উমেশ কেমন করিয়া সাম্বন দিতে হয় ভাবিয়া পাইল না। অবশেষে অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া হঠাৎ এক সময়ে বলিয়া উঠিল, “ম, তুমি ষে সেই টাকাটা দিয়াছিলে, তার থেকে সাত আন বঁাচিয়াছে।” তখন কমলার অশ্রুর ভার লঘু হইয়াছে। উমেশের এই খাপছাড়া সংবাদে সে একটুখানি স্নেহমিশ্রিত হাসি হাসিয়া কহিল, ”আচ্ছ, বেশ, সে তোর কাছে রাখিয়া দে । যা, এখন শুতে যা ।” চাদ গাছের আড়ালে নামিয়া পড়িল । এবার কমলা বিছানায় আসিয়া যেমন শুইল অমনি তাহার দুই শ্রান্ত চক্ষু ঘুমে বুজিয়া আসিল। প্রভাতের রৌদ্র যখন তাহার ঘরের দ্বারে করাঘাত করিল তখনো সে নিজায় মগ্ন । , ●|〉b"