পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৬২ রবীন্দ্র-রচনাবলী ২৮ শ্রাস্তির মধ্যে পরের দিন কমলার দিবসারম্ভ হইল । সেদিন তাহার চক্ষে স্বর্ষের আলোক ক্লাস্ত, নদীর ধারা ক্লাস্ত, তীরের তরুগুলি বহুদূরপথের পথিকের মতো ক্লান্ত । উমেশ যখন তাহার কাজে সহায়তা করিতে আসিল কমলা শ্রাস্তকণ্ঠে কহিল, “বা উমেশ, আমাকে আজ আর বিরক্ত করিস নে ৷” উমেশ অল্পে ক্ষাস্ত হইবার ছেলে নহে। সে কহিল, “বিরক্ত করিব কেন মা, বাটনা বাটিতে আসিয়াছি।” সকাল বেলা রমেশ কমলার চোখমুখের ভাব দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, “কমলা তোমার কি অমুখ করিয়াছে ?” এরূপ প্রশ্ন যে কতখানি অনাবশ্যক ও অসংগত, কমলা কেবল তাহ এক বার প্রবল গ্রীবা-আন্দোলনের দ্বারা নিরুত্তরে প্রকাশ করিয়া রান্নাঘরের দিকে চলিয়া গেল । রমেশ বুঝিল, সমস্ত ক্রমশ প্রতিদিনই কঠিন হইয়া আসিতেছে। অতিশীঘ্রই ইহার একটা শেষ মীমাংসা হওয়া আবশ্যক। হেমনলিনীর সঙ্গে এক বার স্পষ্ট বোঝাপড়া হইয়া গেলে কর্তব্যনির্ধারণ সহজ হইবে, ইহা রমেশ মনে মনে আলোচনা করিয়া দেখিল । অনেক চিন্তার পর হেমকে চিঠি লিখিতে বসিল । এক বার লিখিতেছে, এক বার কাটিতেছে, এমন সময় “মহাশয়, আপনার নাম ?” শুনিয়া চমকিয়া মুখ তুলিল । দেখিল, একটি প্রৌঢ়বয়স্ক ভদ্রলোক পাকা গোফ ও মাথার সামনের দিকটায় পাতলা চুলে টাকের আভাস লইয়া সম্মুখে উপস্থিত। রমেশের একান্তনিবিষ্ট চিত্তের মনোযোগ চিঠির চিস্ত হইতে অকস্মাৎ উৎপাটিত হইয়া ক্ষণকালের জন্ত বিভ্রাস্ত হইয়া রহিল। “আপনি ব্রাহ্মণ ? নমস্কার। আপনার নাম রমেশবাবু, সে আমি পূর্বেই খবর লইয়াছি– তবু দেখুন আমাদের দেশে নাম-জিজ্ঞাসাটা পরিচয়ের একটা প্রণালী । ওটা ভদ্রতা। আজকাল কেহ কেহ ইহাতে রাগ করেন। আপনি যদি রাগ করিয়া থাকেন তো শোধ তুলুন। আমাকে জিজ্ঞাসা করুন, আমি নিজের নাম বলিব, বাপের নাম বলিব, পিতামহের নাম বলিতে আপত্তি করিব না।” রমেশ হাসিয়া কহিল, “আমার রাগ এত বেশি ভয়ংকর নয়, আপনার একলার নাম পাইলেই আমি খুশি হইব।”