পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৬৬ রবীন্দ্র-রচনাবলী ইহার পরে উমেশ এবং চক্রবর্তীতে মিলিয়া লজ্জিত কমলার কামরায় সভাস্থাপন করিল। রমেশ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বাহিরেই রহিয়া গেল। মধ্যাহ্নে জাহাজ ধক ধক করিয়া চলিয়াছে। শারদরৌত্ররঞ্জিত দুই তীরের শাস্তিময় বৈচিত্র্য স্বপ্নের মতো চোখের উপর দিয়া পরিবর্তিত হইয়া চলিয়াছে । কোথাও বা ধানের খেত, কোথাও বা নৌকা-লাগানো ঘাট, কোথাও বা বালুর তীর, কোথাও বা গ্রামের গোয়াল, কোথাও বা গঞ্জের টিনের ছাদ, কোথাও বা প্রাচীন ছায়াবটের তলে খেয়াতরীর-অপেক্ষী দুটি-চারটি পারের যাত্রী। এই শরৎমধ্যাহের স্বমধুর স্তব্ধতার মধ্যে অদূরে কামরার ভিতর হইতে যখন ক্ষণে ক্ষণে কমলার স্নিগ্ধ কৌতুকহাস্ত রমেশের কানে আসিয়া প্রবেশ করিল তখন তাহার বুকে বাজিতে লাগিল। সমস্তই কী স্বন্দর, অথচ কী মৃদুর। রমেশের আর্ত জীবনের সহিত কী নিদারুণ আঘাতে বিচ্ছিন্ন ! ૨૨ কমলার এখনো অল্প বয়স— কোনো সংশয় আশঙ্কা বা বেদনা স্থায়ী হইয়া তাহার মনের মধ্যে টিকিয়া থাকিতে পারে না । রমেশের ব্যবহার সম্বন্ধে এ কয়দিন সে আর কোনো চিন্তা করিবার অবকাশ পায় নাই। স্রোত যেখানে বাধা পায় সেইখানে যত আবর্জনা আসিয়া জমে - কমলার চিত্তস্রোতের সহজ প্রবাহ রমেশের আচরণে হঠাৎ একটা জায়গায় বাধা পাইয়াছিল, সেইখানে আবর্ত রচিত হইয়া নানা কথা বারবার একই জায়গায় ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। বৃদ্ধ চক্রবর্তীকে লইয়া হাসিয়া, বকিয়া, রাধিয়া, খাওয়াইয়া কমলার হৃদয়শ্রোত আবার সমস্ত বাধা অতিক্রম করিয়া চলিয়া গেল ; আবর্ত কাটিয়া গেল যাহা-কিছু জমিতেছিল এবং ঘুরিতেছিল তাহ সমস্ত ভাসিয়া গেল। সে আপনার কথা আর কিছুই ভাবিল না। আশ্বিনের সুন্দর দিনগুলি নদীপথের বিচিত্র দৃশ্যগুলিকে রমণীয় করিয়া তাহারই মাঝখানে কমলার এই প্রতিদিনের আনন্দিত গৃহিণীপনাকে যেন সোনার জলের ছবির মাঝখানে এক-একটি সরল কবিতার পৃষ্ঠার মতো উলটাইয়া যাইতে লাগিল । কর্মের উৎসাহে দিন আরম্ভ হইত। উমেশ আজকাল আর স্টীমার ফেল করে ন, কিন্তু তাহার ঝুড়ি ভর্তি হইয়া আসে। ক্ষুত্র ঘরকার মধ্যে উমেশের এই সকালবেলাকার ঝুড়িটা পরম কৌতুহলের বিষয় । এ কী রে, এ যে লাউভগা !