পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৬৮ রবীন্দ্র-রচনাবলী তাহার পক্ষ লওয়াতে রমেশের সহিত কমলার দলটি যেন বেশ একটু স্বতন্ত্র হইয়া আসিল। রমেশ তাহার স্থঙ্ক বিচারশক্তি লইয়া এক দিকে এক ; অন্য দিকে কমলা উমেশ এবং চক্রবতী তাহদের কর্মস্থত্রে, স্নেহস্থত্রে, আমোদ-আহ্নাদের স্থত্রে ঘনিষ্ঠভাবে এক। চক্রবর্তী আসিয়া অবধি র্তাহার উৎসাহের সংক্রামক উত্তাপে রমেশ কমলাকে পূর্বাপেক্ষ বিশেষ ঔৎস্থক্যের সহিত দেখিতেছে, কিন্তু তবু দলে মিশিতে পারিতেছে না। বড়ো জাহাজ যেমন ডাঙায় ভিড়িতে চায়, কিন্তু জল কম বলিয়া তাহাকে তফাতে নোঙর ফেলিয়া দূর হইতে তাকাইয়া থাকিতে হয়, এ দিকে ছোটো ছোটো ডিঙি-পানসিগুলো অনায়াসেই তীরে গিয়া ভিড়ে, রমেশের সেই দশা হইয়াছে। পূৰ্ণিমার কাছাকাছি এক দিন সকালে উঠিয়া দেখা গেল, রাশি রাশি কালে মেঘ দলে দলে আকাশ পূর্ণ করিয়া ফেলিয়াছে। বাতাস এলোমেলো বহিতেছে। বৃষ্টি এক-এক বার আসিতেছে, আবার এক-এক বার ধরিয়া গিয়া রৌদ্রের আভাসও দেখা যাইতেছে। মাঝগঙ্গায় আজ আর নৌকা নাই, দু-একখানা যা দেখা যাইতেছে তাহাদের উৎকণ্ঠিত ভাব স্পষ্টই বুঝা যায়। জলাধিনী মেয়েরা আজ ঘাটে অধিক বিলম্ব করিতেছে না। জলের উপরে মেঘবিচ্ছুরিত একটা রুদ্র আলোক পড়িয়াছে এবং ক্ষণে ক্ষণে নদীনীর এক তীর হইতে আর-এক তীর পর্যস্ত শিহরিয়া উঠিতেছে। স্ট্রীমার যথানিয়মে চলিয়াছে। দুর্যোগের নানা অসুবিধার মধ্যে কোনোমতে কমলার রাধাবাড়া চলিতে লাগিল। চক্রবর্তী আকাশের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “ম, ও বেল যাহাতে রাধিতে না হয় তাহার ব্যবস্থা করিতে হইবে। তুমি খিচুড়ি চড়াইয়া দাও, আমি ইতিমধ্যে রুটি গড়িয়া রাখি।” খাওয়াদাওয়া শেষ হইতে আজ অনেক বেলা হইল। দমকা হাওয়ার জোর ক্রমে বাড়িয়া উঠিল। নদী ফেনাইয়া ফেনাইয়া ফুলিতে লাগিল । সূর্য অস্ত গেছে কি না বুঝা গেল না। সকাল-সকাল ষ্টীমার নোঙর ফেলিল । সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গেল। ছিন্নবিচ্ছিন্ন মেঘের মধ্য হইতে বিকারের পাংশুবর্ণ হাসির মতো একবার জ্যোৎস্নার আলো বাহির হইতে লাগিল। তুমুলবেগে বাতাস এবং মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হইল । কমলা একবার জলে ডুবিয়াছে— ঝড়ের ঝাপটাকে সে অগ্রাহ করিতে পারে না। রমেশ আসিয়া তাহাকে আশ্বাস দিল, "মারে কোনো ভয় নাই কমলা। তুমি নিশ্চিন্ত হইয়া ঘুমাইতে পার, আমি পাশের ঘরেই জাগিয়া আছি।”