পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি २>S কমলা। আমার কাজ আছে বলিয়া ধুলা সহিতেছি ; তোমার কাজ নাই, তুমি কেন ধুলা সহিবে ? রমেশ ভৃত্যদের কান বঁাচাইয়া মৃদুস্বরে কহিল, “কাজ থাক বা না থাকৃ, তুমি যাহা সহ করিবে আমি তাহার অংশ লইব ।” কমলার কর্ণমূল একটুখানি লাল হইয়া উঠিল ; রমেশের কথার কোনো উত্তর না দিয়া কমলা একটু সরিয়া গিয়া কহিল, উমেশ, এইখানটায় আর-এক ঘড়ী জল ঢাল না— দেখছিস নে কত কাদা জমিয়া আছে ? কাটাটা আমার হাতে দে দেখি ।” বলিয়া বঁটা লইয়া খুব বেগে মার্জনকার্বে নিযুক্ত হইল । রমেশ কমলাকে বাট দিতে দেখিয়া হঠাৎ অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া কহিল, “আহা কমলা, ও কী করিতেছ ?” পিছন হইতে শুনিতে পাইল, “কেন রমেশবাবু, অন্যায় কাজটা কী হইতেছে ? এ দিকে ইংরাজি পড়িয়া আপনারা মুখে সাম্য প্রচার করেন ; বাট দেওয়ার কাজটা যদি এত হেয় মনে হয় তবে চাকরের হাতেই বা কাটা দেন কেন ? আমি মূখ, আমার কথা যদি জিজ্ঞাসা করেন, সতী মায়ের হাতের ওই বাটার প্রত্যেক কাঠি স্বর্ষের রশ্মিচ্ছটার মতো আমার কাছে উজ্জল ঠেকে। মা, তোমার জঙ্গল আমি একরকম প্রায় শেষ করিয়া আসিলাম, কোনখানে তরকারির খেত করিবে আমাকে এক বার দেখাইয়া দিতে হইবে।” কমলা কহিল, “খুড়ামশায়, একটুখানি সবুর করে, আমার এ ঘর সারা হইল বলিয়া ।” এই বলিয়া কমলা ঘর-পরিষ্কার শেষ করিয়া কোমরে-জড়ানো আঁচল মাথায় তুলিয়া বাহিরে আসিয়া খুড়ার সহিত তরকারির খেত লইয়া গভীর আলোচনায় প্রবৃত্ত হইল । এমনি করিয়া দেখিতে দেখিতে দিন শেষ হইয়া গেল, কিন্তু ঘর-গোছানো এখনো ঠিকমত হইয়া উঠিল না। বাংলাঘর অনেকদিন অব্যবহৃত ও রুদ্ধ ছিল, আরও দুইচারি দিন ঘরগুলি ধোওয়া-মাজা করিয়া জানলা-দরজা খুলিয়া না রাখিলে তাহ বাসযোগ্য হইবে না দেখা গেল। কাজেই জাবার অাজ সন্ধ্যার পরে খুড়ার বাড়িতেই আশ্রয় লইতে হইল। আজ তাহাতে রমেশের মনটা কিছু দমিয়া গেল। আজ তাহাদের নিজের নিভৃত ঘরটিতে সন্ধ্যাপ্রদীপটি জলিবে এবং কমলার সলঙ্গ স্থিতহাস্তটির সম্মুখে রমেশ আপনার পরিপূর্ণ হৃদয় নিবেদন করিয়া দিবে, ইহা সে সমস্ত দিন থাকিয়া থাকিয়া কল্পনা করিতেছিল।