পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩২৪ রবীন্দ্র-রচনাবলী সন্দেহ করিতে আমি প্রস্তুত নই। নলিনাক্ষবাবু যে-সব কথা বলিয়াছেন এ-সমস্ত পরের মুখের কথা নহে; তাহার নিজের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার ভিতর হইতে তিনি যাহা প্রকাশ করিয়াছেন আমার পক্ষে আজ তাহ নূতন লাভ বলিয়া মনে হইয়াছে। যে ব্যক্তি কপট সে ব্যক্তি সত্যকার জিনিস দিবে কোথা হইতে ? সোনা যেমন বানানো যায় না এ-সব কথাও তেমনি বানানো যায় না। আমার ইচ্ছা হইয়াছে নলিনাক্ষবাবুকে আমি নিজে গিয়া সাধুবাদ দিয়া আসিব ।” অক্ষয় কহিল, “আমার ভয় হয়, ইহার শরীর টেকে কি না।” অন্নদাবাবু ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “কেন, ইহার শরীর কি ভালো নয় ?” অক্ষয়। ভালো থাকিবার তো কথা নয় ; দিনরাত্রি আপনার সাধনা এবং শাস্ত্রালোচনা লইয়াই আছেন, শরীরের প্রতি তো আর দৃষ্টি নাই। অন্নদা কহিলেন, “এটা ভারি অন্যায়। শরীর নষ্ট করিবার অধিকার আমাদের নাই ; আমরা আমাদের শরীর স্বাক্ট করি নাই। আমি যদি উহাকে কাছে পাইতাম তবে নিশ্চয়ই অল্পদিনেই আমি উহার স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করিয়া দিতে পারিতাম। আসলে স্বাস্থ্যরক্ষার গুটিকতক সহজ নিয়ম আছে, তাহার মধ্যে প্রথম হচ্ছে--" যোগেন্দ্র অধৈর্য হইয়া কহিল, “বাবা, বৃথা কেন তোমরা ভাবিয়া মরিতেছ ? নলিনাক্ষবাবুর শরীর তো দিব্য দেখিলাম ; তাহাকে দেখিয়া আজ আমার বেশ বোধ হইল, সাধুত্ব-জিনিসটা স্বাস্থ্যকর। আমার নিজেরই মনে হইতেছে, ওটা চেষ্টা করিয়া দেখিলে হয় ।” অন্নদা কহিলেন, “না যোগেন্দ্র, অক্ষয় যাহা বলিতেছে তাহা হইতেও পারে । আমাদের দেশে বড়ো বড়ো লোকেরা প্রায় অল্প বয়সেই মারা যান, ইহারা নিজের শরীরকে উপেক্ষা করিয়া দেশের লোকসান করিয়া থাকেন । এটা কিছুতে ঘটিতে দেওয়া উচিত নয়। যোগেন্দ্র, তুমি নলিনাক্ষবাবুকে যাহা মনে করিতেছ তাহা নয়, উহার মধ্যে আসল জিনিস আছে। উহাকে এখন হইতেই সাবধান করিয়া দেওয়া দরকার।" অক্ষয়। আমি উহাকে আপনার কাছে আনিয়া উপস্থিত করিব। আপনি যদি উহাকে একটু ভালো করিয়া বুঝাইয়া দেন তো ভালো হয়। আর, আমার মনে হয়, আপনি সেই-যে শিকড়ের রসটা আমাকে পরীক্ষার সময় দিয়াছিলেন সেটা আশ্চর্য বলকারক। যে-কোনো লোক সর্বদা মনকে খাটাইতেছে তাহার পক্ষে এমন মহৌষধ আর নাই। আপনি যদি একবার নলিনাক্ষবাবুকে— যোগেন্দ্র একেবারে চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িয়া কহিল, “আ: অক্ষয়, তুমি জালাইলে । বড়ো বাড়াবাড়ি করিতেছ। আমি চলিলাম।”