পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩৩২ রবীন্দ্র-রচনাবলী মেজে হইতে মাদুর ও কার্পেট তুলিয়া ফেলিয়া বিছানাটি একধারে পর্দার দ্বারা আড়াল করিল ; সে ঘরে আর কোনো জিনিস রাখিল না। সেই মেজে প্রত্যহ হেমনলিনী স্বহস্তে জল ঢালিয়া পরিষ্কার করিত— একটি রেকাবিতে কয়েকটি ফুল থাকিত ; স্নানান্তে শুভ্ৰবস্ত্র পরিয়া সেইখানে মেজের উপরে হেমনলিনী বসিত ; সমস্ত মুক্ত বাতায়ন দিয়া ঘরের মধ্যে অবারিত আলোক প্রবেশ করিত এবং সেই আলোকের দ্বারা, আকাশের দ্বারা, বায়ুর দ্বারা সে আপনার অন্তঃকরণকে অভিষিক্ত করিয়া লইত। অন্নদাবাবু সম্পূর্ণভাবে হেমনলিনীর সহিত যোগ দিতে পারিতেন না ; কিন্তু নিয়মপালনের দ্বারা হেমনলিনীর মুথে যে-একটি পরিতৃপ্তির দীপ্তি প্রকাশ পাইত তাহ দেখিয়া বৃদ্ধের মন স্নিগ্ধ হইয়া যাইত। এখন হইতে নলিনাক্ষ আসিলে হেমনলিনীর এই ঘরেই মেজের উপরে বসিয়া তাহাদের তিন জনের মধ্যে আলোচনা চলিত । যোগেন্দ্র একেবারে বিদ্রোহী হইয়া উঠিল—‘এ-সমস্ত কী হইতেছে ? তোমরা যে সকলে মিলিয়া বাড়িটাকে ভয়ংকর পবিত্র করিয়া তুলিলে— আমার মতো লোকের এখানে পা ফেলিবার জায়গা নাই ।” আগে হইলে যোগেন্দ্রের বিদ্রুপে হেমনলিনী অত্যন্ত কুষ্ঠিত হইয়া পড়িত— এখন অন্নদাবাবু যোগেন্দ্রের কথায় মাঝে মাঝে রাগ করিয়া উঠেন, কিন্তু হেমনলিনী নলিনাক্ষের সঙ্গে যোগ দিয়া শাস্তস্নিগ্ধভাবে হাস্য করে । এখন সে একটি দ্বিধাহীন নিশ্চিত নির্ভর অবলম্বন করিয়াছে— এ সম্বন্ধে লজ্জা করাকেও সে দুর্বলতা বলিয়৷ জ্ঞান করে। লোকে তাহার এখনকার সমস্ত আচরণকে অদ্ভূত মনে করিয়া পরিহাস করিতেছে তাহা সে জানিত ; কিন্তু নলিনাক্ষের প্রতি তাহার ভক্তি ও বিশ্বাস সমস্ত লোককে আচ্ছন্ন করিয়া উঠিয়াছে– এইজন্য লোকের সম্মুখে সে আর সংকুচিত হইত না । এক দিন হেমনলিনী প্রাতঃস্নানের পর উপাসনা শেষ করিয়া তাহার সেই নিভৃত ঘরটিতে বাতায়নের সম্মুখে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া আছে, এমন সময় হঠাৎ অন্নদাবাবু নলিনাক্ষকে লইয়া সেখানে উপস্থিত হইলেন। হেমনলিনীর হৃদয় তখন পরিপূর্ণ ছিল। সে তৎক্ষণাং ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রথমে নলিনাক্ষকে ও পরে তাহার পিতাকে প্ৰণাম করিয়া পদধূলি গ্রহণ করিল। নলিনাক্ষ সংকুচিত হইয়া উঠিল। অন্নদাবাৰু কহিলেন, “ব্যস্ত হইবেন না নলিনবাবু, হেম আপনার কর্তব্য করিয়াছে।” অন্যদিন এত সকালে নলিনাক্ষ এখানে আসে না। তাই বিশেষ ঔৎস্থক্যের সহিত হেমনলিনী তাহার মুখের দিকে চাহিল। নলিনাক্ষ কছিল, “কাশী হইতে