পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি w©©ዓ 86. রমেশ প্রত্যুষেই এলাহাবাদ হইতে গাজিপুরে ফিরিয়া আসিল । তখন রাস্তায় অধিক লোক ছিল না, এবং শীতের জড়িমায় রাস্তার ধারের গাছগুলা যেন পল্লবাবরণের মধ্যে আড়ষ্ট হইয়া দাড়াইয়া ছিল। পাড়ার বস্তিগুলির উপরে তখনো একখানা করিয়া সাদা কুয়াশা, ডিম্বগুলির উপরে নিস্তব্ধ-আসীন রাজহংসের মতো স্থির হইয়া ছিল। সেই নির্জন পথে গাড়ির মধ্যে একটা মস্ত মোটা ওভারকোটের নীচে রমেশের বক্ষঃস্থল চঞ্চল হৃৎপিণ্ডের আঘাতে কেবলই তরঙ্গিত হইতেছিল। বাংলার বাহিরে গাড়ি দাড় করাইয়া রমেশ নামিল। ভাবিল, গাড়ির শব্দ নিশ্চয়ই কমলা শুনিয়াছে, শব্দ শুনিয়া সে হয়তো বারান্দায় বাহির হইয়া আসিয়াছে। স্বহস্তে কমলার গলায় পরাইয়া দিবার জন্য এলাহাবাদ হইতে রমেশ একটি দামি নেকলেস কিনিয়া আনিয়াছে ; তাহারই বাক্সট রমেশ তাহার ওভারকোটের বৃহৎ পকেট হইতে বাহির করিয়া লইল । বাংলার সম্মুখে আসিয়া রমেশ দেখিল, বিষন-বেহার বারান্দায় শুইয়া অকাতরে নিদ্রা দিতেছে-— ঘরের দ্বারগুলি বন্ধ। বিমর্ষমুখে রমেশ একটু থমকিয়া দাড়াইল । একটু উচ্চস্বরে ডাকিল, “বিষন !” ভাবিল, এই ডাকে ঘরের ভিতরকার নিদ্রাও ভাঙিবে । কিন্তু এমন করিয়া নিদ্রা ভাঙাইবার যে অপেক্ষা আছে, ইহাই তাহার মনে বাজিল ; রমেশ তো অর্ধেক রাত্রি ঘুমাইতে পারে নাই। দুই-তিন ডাকেও বিষন উঠিল না ; শেষকালে ঠেলিয়া তাহাকে উঠাইতে হইল। বিষন উঠিয়া বসিয়া ক্ষণকাল হতবুদ্ধির মতো তাকাইয়া রহিল। রমেশ জিজ্ঞাসা করিল, “বহুজি ঘরে আছেন ?” বিষন প্রথমটা রমেশের কথা যেন বুঝিতেই পারিল না ; তাহার পরে হঠাৎ চমকিত হইয়া উঠিয়া কহিল, "হুঁ, তিনি ঘরেই আছেন।” এই বলিয়া সে পুনর্বার শুইয়া পড়িয়া নিদ্র। দিবার উপক্রম করিল। রমেশ দ্বার ঠেলিতেই দ্বার খুলিয়া গেল। ভিতরে গিয়া ঘরে ঘরে ঘুরিয়া দেখিল, কেহ কোথাও নাই। তথাপি একবার উচ্চৈঃস্বরে ডাকিল, “কমলা !” কোথাও কোনো সাড়া পাইল না। বাহিরের বাগানে নিমগাছতলা পর্যন্ত ঘুরিয়া আসিল ; রান্নাঘরে, চাকরদের ঘরে, আস্তাবল-ঘরে সন্ধান করিয়া আসিল ; কোথাও কমলাকে দেখিতে পাইল না। তখন রৌদ্র উঠিয়া পড়িয়াছে— কাকগুলা ডাকিতে আরম্ভ করিয়াছে এবং বাংলার ইদারা হইতে জল লইবার জন্য কলস মাথায় পাড়ার মেয়ে