পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি w®8ጫ যোগেন্দ্র। আমি কোনোখানে এক পা নড়িব না, আমি এই কেদারাটার উপরে অটল হইয়া বসিয়া তোমার কথার প্রত্যেক অক্ষর বিশ্বাস করিব । তোমার সকল কথাই বিশ্বাস করা আমার চিরকালের অভ্যাস ; জীবনে একবারমাত্র তাহার ব্যত্যয় হইয়াছে, সেজন্য আমি তোমার কাছে মাপ চাই । i এই বলিয়া যোগেন্দ্র চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া রমেশের সম্মুখে আসিল ; রমেশ উঠিয়া দাড়াইতেই দুই বাল্যবন্ধু এক বার পরস্পর কোলাকুলি করিল। রমেশ রুদ্ধ কণ্ঠ পরিষ্কার করিয়া লইয়া কহিল, “আমি কোথা হইতে ভাগ্যরচিত এমন একটা দুশ্চেষ্ঠ মিথ্যার জালে জড়াইয়া পড়িয়ছিলাম যে, তাহার মধ্যেই সম্পূর্ণ ধরা দেওয়া ছাড়া আমি কোনো দিকেই কোনো উপায় দেখিতে পাই নাই । আজ যে আমি তাহা হইতে মুক্ত হইয়াছি, আর যে আমার কাহারও কাছে কিছুই গোপন করিবার নাই, ইহাতে আমি প্রাণ পাইয়াছি। কমলা কী জানিয়া, কী ভাবিয়া আত্মহত্যা করিল, তাহা আমি আজ পর্যন্ত বুঝিতে পারি নাই, আর বুঝিবার কোনো সম্ভাবনাও নাই– কিন্তু ইহা নিশ্চয়, মৃত্যু যদি এমন করিয়া আমাদের দুই জীবনের এই কঠিন গ্রন্থি কাটিয়া না দিত, তবে শেষকালে আমরা দুজনে যে কোন দুৰ্গতির মধ্যে গিয়া দাড়াইতাম তাহা মনে করিলে এখনো আমার হৃৎকম্প হয়। মৃত্যুর গ্রাস হইতে এক দিন যে সমস্ত অকস্মাৎ উঠিয়া আসিয়াছিল, মৃত্যুর গর্ভেই এক দিন সেই সমস্ত তেমনি অকস্মাং বিলীন হইয়া গেল।” o যোগেন্দ্র । কমলা যে নিশ্চয়ই আত্মহত্যা করিয়াছে তাহ অসংশয়ে স্থির করিয়া বসিয়ে না। সে যাই হোক, তোমার এ দিকটা তো পরিষ্কার হইয়া গেল, এখন নলিনাক্ষের কথা আমি ভাবিতেছি । তাহার পরে যোগেজ নলিনাক্ষকে লইয়া পড়িল। কহিল, “আমি ওরকম লোকদের ভালো বুঝি না এবং যাহা বুঝি না তাহা আমি পছন্দও করি না। কিন্তু অনেক লোকের অন্যরকম মতিই দেখি, তাহারা যাহা বোঝে না তাহাই বেশি পছন্দ করে। তাই হেমের জন্য আমার যথেষ্ট ভয় আছে। যখন দেখিলাম, সে চা ছাড়িয়া দিয়াছে, মাছ-মাংসও খায় না, এমনকি, ঠাট্টা করিলে পূর্বের মতো তাহার চোখ ছলছল করিয়া আসে না, বরং মৃদুমন্দ হাসে, তখন বুঝিলাম, গতিক ভালো নয়। যাই হোক, তোমাকে সহায় পাইলে তাহাকে উদ্ধার করিতে কিছুমাত্র বিলম্ব হইবে না তাহীও আমি নিশ্চয় জানি ; অতএব প্রস্তুত হও, দুই বন্ধু মিলিয়া সন্ন্যাসীর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্র করিতে হইবে।” - *