পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩৬২ রবীন্দ্র-রচনাবলী QS কমলা যখন গঙ্গাতীরে গিয়া পৌছিল, শীতের সূর্য তখন রশ্মিচ্ছটাহীন মান পশ্চিমাকাশের প্রাস্তে নামিয়াছেন। কমলা আসন্ন অন্ধকারের সম্মুখীন সেই অস্তগামী সূর্যকে প্রণাম করিল। তাহার পরে মাথায় গঙ্গাজলের ছিটা দিয়া নদীর মধ্যে কিছুদূর নামিল এবং জোড়করপুটে গঙ্গায় জলগওষ অঞ্জলি দান করিয়া ফুল ভাসাইয়া দিল। তার পর সমস্ত গুরুজনদের উদ্দেশ করিয়া প্রণাম করিল। প্রণাম করিয়া মাথা তুলিতেই আর-একটি প্ৰণম্য ব্যক্তির কথা সে মনে করিল। কোনোদিন মুখ তুলিয়া তাহার মুখের দিকে সে চাহে নাই ; যখন এক দিন রাত্রে সে তাহার পাশে বসিয়াছিল ; তখন র্তাহার পায়ের দিকেও তাহার চোখ পড়ে নাই, বাসরঘরে অন্ত মেয়েদের সঙ্গে তিনি যে দুই-চারিটা কথা কহিয়াছিলেন তাহাও সে যেন ঘোমটার মধ্য দিয়া, লজ্জার মধ্য দিয়া, তেমন সুস্পষ্ট করিয়া শুনিতে পায় নাই। র্তাহার সেই কণ্ঠস্বর স্মরণে আনিবার জন্য আজ এই জলের ধারে দাড়াইয়া সে একান্তমনে চেষ্টা করিল, কিন্তু কোনোমতেই মনে আসিল না । অনেক রাত্রে তাহার বিবাহের লগ্ন ছিল ; নিতান্ত শ্রাস্তশরীরে সে যে কথন কোথায় ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল তাহাও মনে নাই; সকালে জাগিয়া দেখিল, তাহদের প্রতিবেশীর বাড়ির একটি বধূ তাহাকে ঠেলিয়া জাগাইয় খিলখিল করিয়া হাসিতেছে — বিছানায় আর-কেহই নাই। জীবনের এই শেষ মুহূর্তে জীবনেশ্বরকে স্মরণ করিবার সম্বল তাহার কিছুমাত্র নাই । সে দিকে একেবারে অন্ধকার— কোনো মূর্তি নাই, কোনো বাক্য নাই, কোনো চিহ্ন নাই। ষে লাল চেলিটির সঙ্গে তাহার চাদরের গ্রন্থি বাধা হইয়াছিল, তারিণীচরণের প্রদত্ত সেই নিতান্ত অল্পদামের চেলির মূল্য তো কমলা জানিত না ; সে চেলিথানিও সে যত্ন করিয়া রাখে নাই। রমেশ হেমনলিনীকে যে চিঠি লিখিয়াছিল সেখানি কমলার আঁচলের প্রান্তে বাধা ছিল ; সেই চিঠি খুলিয়া বালুতটে বসিয়া তাহার একটি অংশ গোধূলির আলোকে পড়িতে লাগিল। সেই অংশে তাহার স্বামীর পরিচয় ছিল— বেশি কথা নয়, কেবল র্তাহার নাম নলিনাক্ষ চট্টোপাধ্যায়, আর তিনি যে রঙপুরে ডাক্তারি করিতেন ও এখন সেখানে তাহার খোজ পাওয়া যায় না, একটুকুমাত্র। চিঠির বাকি অংশ সে অনেক সন্ধান করিয়াও পায় নাই। 'নলিনাক্ষ’ এই নামটি তাহার মনের মধ্যে স্থধাবর্ষণ করিতে লাগিল ; এই নামটি তাহার সমস্ত বুকের ভিতরটা যেন ভরিয়া তুলিল ; এই নামটি যেন এক বস্তুহীন দেহ লইয়া তাহাকে আবিষ্ট করিয়া ধরিল ; তাহার চোখ দিয়া অবিশ্রাম ধারা বাহিয়া জল পড়িয়া তাহার হৃদয়কে