পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি ○や° ¢२ নবীনকালীর আশ্রয়ে কমলার প্রাণটা যেন অল্পজল এদো-পুকুরের মাছের মতো ব্যাকুল হইয়া উঠিতে লাগিল। এখান হইতে বাহির হইতে পারিলে সে বঁাচে, কিন্তু বাহিরে গিয়া দাড়াইবে কোথায় ? সেদিনকার রাত্রে গৃহহীন বাহিরের পৃথিবীকে সে জানিয়াছে ; সেখানে অন্ধভাবে আত্মসমপণ করিতে আর তাহার সাহস হয় না । নবীনকালী যে কমলাকে ভালোবাসিতেন না তাহা নহে, কিন্তু সে ভালোবাসার মধ্যে রস ছিল না। দুই-এক দিন অস্থখ-বিস্তুখের সময় তিনি কমলাকে যত্ত্বও করিয়াছিলেন, কিন্তু সে ষত্ব কৃতজ্ঞতার সহিত গ্রহণ করা বড়ো কঠিন। বরঞ্চ সে কাজকর্মের মধ্যে থাকিত ভালো, কিন্তু যে-সময়টা নবীনকালীর সখীত্বে তাহাকে যাপন করিতে হইত সেইটেই তার পক্ষে সব চেয়ে দুঃসময় । * এক দিন সকালবেলা নবীনকালী কমলাকে ডাকিয়া কহিলেন, “ওগে, ও বামুনঠাকরুন, আজ কর্তার শরীর বড়ো ভালো নাই, আজ ভাত হইবে না, আজ রুটি । কিন্তু তাই বলিয়া একরাশ ঘি লইয়ো না । জানি তো তোমার রান্নার ঐ, উহাতে এত ঘি কেমন করিয়া খরচ হইবে তাহা তো বুঝিতে পারি না । এর চেয়ে সেই-ষে উড়ে বামুনটা ছিল ভালো, সে ঘি লইত বটে, কিন্তু রান্নায় ঘিয়ের স্বাদ একটু-আধটু পাওয়া बांझेऊ ।” û কমলা এ-সমস্ত কথার কোনো জবাবই করিত না ; যেন শুনিতে পায় নাই, এমনিভাবে নিঃশব্দে সে কাজ করিয়া যাইত। আজ অপমানের গোপনভারে আক্রাস্তহৃদয় হইয়া কমলা চুপ করিয়া তরকারি কুটিতেছিল, সমস্ত পৃথিবী বিরস এবং জীবনটা দুঃসহ বোধ হইতেছিল, এমন সময় । গৃহিণীর ঘর হইতে একটা কথা তাহার কানে আসিয়া কমলাকে একেবারে চকিত করিয়া তুলিল। নবীনকালী তাহার চাকরকে ভাকিয়া বলিতেছিলেন, “ওরে তুলসী, যা তো, শহর হইতে নলিনাক্ষ ডাক্তারকে শীঘ্ৰ ডাকিয়া আন । বল, কর্তার শরীর বড়ো খারাপ ।” নলিনাক্ষ ডাক্তার ! কমলার চোখের উপরে সমস্ত আকাশের আলো আহত বীণার স্বর্ণতন্ত্রীর মতে কঁাপিতে লাগিল। সে তরকারি-কোটা ফেলিয়া দ্বারের কাছে আসিয়া দাড়াইল । তুলসী নীচে নামিয়া আসিতেই কমলা জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় যাইতেছিল তুলসী ?" সে কহিল, "নলিনাক্ষ ডাক্তারকে ডাকিতে যাইতেছি।” কমলা কহিল, “সে জাবার কোন ডাক্তার ?”