পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ه انها নলিনাক্ষ সম্বন্ধে যতদিন কমলা নিশ্চিত ছিল না ততদিন তাহার ধৈর্য ছিল ; এখন তাহার পক্ষে ধৈর্যরক্ষণ করা দুঃসাধ্য হইয়া উঠিল। এই নগরেই তাহার স্বামী রহিয়াছেন, অথচ সে এক মুহূর্তও যে অন্তের ঘরে আশ্রয় লইয়া থাকিবে, ইহা তাহার পক্ষে অসহ্য হইল। কাজকর্মে তাহার পদে পদে ক্রটি হইতে লাগিল । নবীনকালী কহিলেন, “বলি বামুন-ঠাকরুন, তোমার গতিক তো ভালো দেখি না। তোমাকে কি ভূতে পাইয়াছে ? তুমি নিজে তো খাওয়াদাওয়া বন্ধ করিয়াছ, আমাদিগকেও কি উপোস করাইয়া মারিবে ? আজকাল তোমার রান্না ষে আর মুখে দেবার জো নাই।” কমলা কহিল, “আমি এপানে আর কাজ করিতে পারিতেছি না, আমার কোনোমতে মন টিকিতেছে না। আমাকে বিদায় দিন ।” নবীনকালী ঝংকার দিয়া বলিলেন, “বটেই তো ! কলিকালে কাহারও ভালে। করিতে নাই । তোমাকে দয়া করিয়া আশ্রয় দিবার জন্যে আমার এতকালের অমন ভালো বামুনটাকে ছাড়াইয়া দিলাম, একবার খবরও লইলাম না তুমি সত্যি বামুনের মেয়ে কি না । আজ উনি বলেন কিনা, আমাকে বিদায় দিন। যদি পলাইবার চেষ্টা কর তো পুলিসে খবর দিব না! আমার ছেলে হাকিম— তার হুকুমে কত লোক ফাঁসি গেছে, আমার কাছে তোমার চালাকি থাটিবে না । শুনেইছ তো— গদা কর্তার মুখের উপরে জবাব দিতে গিয়াছিল, সে বেটা এমনি জাদ হইয়াছে, আজও সে জেল থাটিতেছে। আমাদের তুমি যেমন-তেমন পাও নাই।” কথাটা মিথ্যা নহে— গদা চাকরকে ঘড়িচুরির অপবাদ দিয়া জেলে পাঠানো হইয়াছে বটে। কমলা কোনো উপায় খুজিয়া পাইল না। তাহার চিরজীবনের সার্থকতা যখন হাত বাড়াইলেই পাওয়া যায়, তপন সেই হাতে বাধন পড়ার মতো এমন নিষ্ঠুর আর কী হইতে পারে। কমলা আপনার কাজের মধ্যে, ঘরের মধ্যে কিছুতেই আর তো বদ্ধ হইয়া থাকিতে পারে না । তাহার রাত্রের কাজ শেষ হইয়া গেলে পর সে শীতে একখানা র্যাপার মুড়ি দিয়া বাগানে বাহির হইয়া পড়িত। প্রাচীরের ধারে দাড়াইয়া, যে পথ শহরের দিকে চলিয়া গেছে সেই পথের দিকে চাহিয়া থাকিত। তাহার যে তরুণ হৃদয়থানি সেবার জন্য ব্যাকুল, ভক্তিনিবেদনের জন্ত ব্যগ্র, সেই হৃদয়কে কমলা এই রজনীর নির্জন পথ বাহিয়া নগরের মধ্যে কোন এক অপরিচিত গৃহের উদ্দেশে প্রেরণ করিত— তাহার পর অনেক ক্ষণ স্তব্ধ হইয়া দাড়াইয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া তাহার শয়নকক্ষের মধ্যে ফিরিয়া জাসিত ।