পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি ●●● তাড়াতাড়ি জল মুছিয়া সে তাহার একাগ্ৰদূষ্টির দ্বারা নলিনাক্ষকে যেন আপনার অস্তঃকরণের গভীরতম অভ্যস্তরদেশে আকর্ষণ করিয়া লইল । ওই-যে উন্নতললাট স্তন্ধ মুখখানির উপরে দীপালোক মূৰ্ছিত হইয়া পড়িয়াছে, ওই মুখ যতই কমলার অস্তরের মধ্যে মুদ্রিত ও পরিস্ফুট হইয়া উঠিতে লাগিল ততই তাহার সমস্ত শরীর যেন ক্রমে অবশ হইয়া চারি দিকের আকাশের সহিত মিলাইয়া যাইতে লাগিল ; বিশ্বজগতের মধ্যে আর-কিছুই রহিল না, কেবল ওই আলোকিত মুখখানি রহিল— যাহার সম্মুখে রহিল সেও ওই মুখের সহিত সম্পূর্ণভাবে মিশিয়া গেল।” এইরূপে কিছুক্ষণ কমলা সচেতন কি অচেতন ছিল, তাহা বলা যায় না ; এমন সময় হঠাৎ সে চকিত হইয়া দেখিল, নলিনাক্ষ চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাড়াইয়াছে এবং মুকুন্দবাবুর সঙ্গে কথা কহিতেছে । এখনি পাছে উহারা বারান্দায় বাহির হইয়া আসেন এবং কমলা ধরা পড়ে এই ভয়ে কমলা বারান্দা ছাড়িয়া নীচে তাহার রান্নাঘরে গিয়া বসিল । রান্নাঘরটি প্রাঙ্গণের এক ধারে, এবং এই প্রাঙ্গণটি বাড়ির ভিতর হইতে বাহির হইয়া যাইবার পথ । কমলা সর্বাঙ্গমনে পুলকিত হইয়া বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল, “আমার মতো হতভাগিনীর এমন স্বামী ! দেবতার মতো এমন সৌম্য-নির্মল প্রসন্ন-স্বন্দর মূর্তি ! ওগে। ঠাকুর, আমার সকল দুঃখ সার্থক হইয়াছে।’ বলিয়া ৰার বার করিয়া ভগবানকে প্রণাম করিল। i সিড়ি দিয়া নীচে নামিবার পদশব্দ শোনা গেল। কমলা তাড়াতাড়ি অন্ধকারে স্বারের পাশে দাড়াইল। বুধিয়া আলো ধরিয়া আগে আগে চলিল, তাহার অনুসরণ করিয়া নলিনাক্ষ বাহির হইয়া গেল । কমলা মনে মনে কহিল, ‘তোমার শ্রীচরণের সেবিকা হইয়া এইখানে পরের স্বারে দাসত্বে আবদ্ধ হইয়া আছি, সন্মুখ দিয়া চলিয়া গেলে, তবু জানিতেও পারিলে না।’ মুকুন্দবাবু অন্তঃপুরে আহার করিতে গেলে কমলা আস্তে আস্তে সেই বসিবার ঘরে গেল। ষে চৌকিতে নলিনাক্ষ বসিয়াছিল তাহার সম্মুখে ভূমিতে ললাট ঠেকাইয়। সেখানকার ধূলি চুম্বন করিল। সেবা করিবার অবকাশ না পাইয়া অবরুদ্ধ ভক্তিতে কমলার হৃদয় কাতর হইয়া উঠিয়াছিল। পরদিন কমলা সংবাদ পাইল, বায়ুপরিবর্তনের জন্য ডাক্তারবাৰু কৰ্তাকে স্থদুর পশ্চিমে কাশীর চেয়ে স্বাস্থ্যকর স্থানে যাইতে উপদেশ করিয়াছেন। তাই আজি হইতে মাত্রাঙ্গয়ােজন আরম্ভ হইছে। o ¢|२¢