পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি W©ዓ> না । তা ছাড়া, তাহার স্বভাব এমন যে, কেহ যে দায়ে পড়িয়া তাহার সেবা করিতেছে ইহা তিনি সহ করিতে পারেন না।” ইহার পরে এ-সম্বন্ধে হেমনলিনীর আর কোনো কথা চলিল না । সে একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “আপনার উপদেশমতে চলিতে চলিতে মাঝে মাঝে এক-একবার বাধা আসিয়া উপস্থিত হয়, আবার আমি পিছাইয়া পড়ি । আমার ভয় হয়, আমার যেন কোনো আশা নাই । আমার কি কোনোদিন মনের একটা স্থিতি হইবে না, আমাকে কি কেবলই বাহিরের আঘাতে অস্থির হইয়া বেড়াইতে হইবে ?” হেমনলিনীর এই কাতর আবেদনে নলিনাক্ষ একটু চিস্তিত হইয়া কহিল, “দেখুন, বিঘ্ন আমাদের হৃদয়ের সমস্ত শক্তিকে জাগ্রত করিয়া দিবার জন্যই উপস্থিত হয় । আপনি হতাশ হইবেন না।” হেমনলিনী কহিল, “কাল সকালে আপনি একবার আসিতে পারিবেন ? আপনার সহায়তা পাইলে আমি অনেকটা বল লাভ করি।” নলিনাক্ষের মুখে এবং কণ্ঠস্বরে যে-একটি অবিচলিত শাস্তির ভাব আছে তাহাতে হেমনলিনী যেন একটা আশ্রয় পায় । নলিনাক্ষ চলিয়া গেল, কিন্তু হেমনলিনীর মনের মধ্যে একটা সান্তনার স্পর্শ রাথিয়া গেল। সে তাহার শয়নগৃহের সম্মুখের বারান্দায় দাড়াইয়া একবার শীতরৌদ্রালোকিত বাহিরের দিকে চাহিল । তাহার চারি দিকে বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে সেই রমণীয় মধ্যাহ্নে কর্মের সহিত বিরাম, শক্তির সহিত শাস্তি, উদযোগের সহিত বৈরাগ্য একসঙ্গে বিরাজ করিতেছিল ; সেই বৃহৎ ভাবের ক্রোড়ে সে আপনার ব্যথিত হৃদয়কে সমর্পণ করিয়া দিল— তখন সূর্যালোক এবং উন্মুক্ত উজ্জল নীলাম্বর তাহার অস্তঃকরণের মধ্যে জগতের নিত্য-উচ্চারিত স্বগভীর আশীর্বচন প্রেরণ করিবার অবকাশ লাভ করিল। হেমনলিনী নলিনাক্ষের মার কথা ভাবিতে লাগিল। কী চিন্তা লইয়া তিনি ব্যাপৃত আছেন, তিনি কেন যে রাত্রে ঘুমাইতে পারিতেছেন না, তাহা হেমনলিনী বুঝিতে পারিল । নলিনাক্ষের সহিত তাহার বিবাহ-প্রস্তাবের প্রথম আঘাত, প্রথম সংকোচ কাটিয়া গেছে। নলিনাক্ষের প্রতি হেমনলিনীর একান্ত নির্ভরপর ভক্তি ক্রমেই বাড়িয়া উঠিয়াছিল, কিন্তু ইহার মধ্যে ভালোবাসার বিদ্যুৎসঞ্চারময়ী বেদনা নাই— তা নাই থাকিল। ওই আত্মপ্রতিষ্ঠ নলিনাক্ষ যে কোনো স্ত্রীলোকের ভালোবাসার অপেক্ষ রাখে, তাহা তো মনেই হয় না। তবু সেবার প্রয়োজন তো সকলেরই আছে। নলিনাক্ষের মাতা পীড়িত এবং প্রাচীন, নলিনাক্ষকে