পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি \రివె(t করিয়া দেখিলেন– কমলা লজ্জায় চক্ষু নত করিয়া বসিয়া রহিল। ক্ষেমংকরী মনে মনে কহিলেন, “আহা, আমি যদি এইরকমের একটি বউ পাইতাম।” সেই রাত্রেই ক্ষেমংকরীর আবার জর আসিল । নলিনাক্ষ উদবিগ্ন হইয়া উঠিল। কহিল, “মা, তোমাকে আমি কিছুদিন কাশী হইতে অন্য কোথাও লইয়া যাইব । এখানে তোমার শরীর ভালো থাকিতেছে না।” ক্ষেমংকরী কহিলেন, “সেটি হবে না বাছা । দু-চার দিন বঁাচাইয়া রাখিবার আশায় আমাকে ষে কাশী ছাড়িয়া অন্য কোথাও লইয়। মারিবি, সেটি হবে না। ও কী মা, তুমি যে দরজার পাশে দাড়াইয়া আছ ? যাও যাও, শুতে যাও । সমস্ত রাত অমন জাগিয়া কাটাইলে চলিবে না। আমি যে-কয়দিন ব্যামোতে আছি তোমাকেই তো সব দেখিতে শুনিতে হইবে । রাত জাগিলে পরিবে কেন ? যা তো নলিন, একবার ও ঘরে যা তো ।” 鱼 নলিনাক্ষ পাশের ঘরে যাইতেই কমলা ক্ষেমংকরীর পদতলে বসিয়া তাহার পায়ে হাত বুলাইতে লাগিল। ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আর-জন্মে নিশ্চয় তুমি আমার মা ছিলে মা । নহিলে কোথাও কিছু নাই তোমাকে এমন করিয়া পাইব কেন ? দেখো, আমার একটা অভ্যাস আছে, আমি বাজে কোনো লোকের সেবা সহিতে পারি না, কিন্তু তুমি আমার গায়ে হাত দিলে আমার গা যেন জুড়াইয়া যায়। আশ্চর্য এই যে, মনে হইতেছে, তোমাকে আমি যেন কতকাল ধরিয়া জানি । তোমাকে তো একটুও পর মনে হয় না। তা, শোনো মা, তুমি নিশ্চিস্তমনে ঘুমাইতে যাও । পাশের ঘরে নলিন রহিল– মার সেবা সে আর কারো হাতে ছাড়িয়া দিতে পারিবে না— তা, হাজার বারণ করি আর যাই করি— ওর সঙ্গে পারিয়া উঠিবে কে বলে। কিন্তু ওর একটি গুণ আছে, রাত জাগুক আর যাই করুক, ওর মুখ দেখিয়া কিছু বুঝা যাইবে না— তার কারণ, ও কখনো কিছুতে অস্থির হয় না। আমার ঠিক তার উলটা। মা, তুমি বোধ করি মনে মনে হাসিতেছ। ভাবিতেছ, নলিনের কথা আরম্ভ হইল, এবারে আর কথা থামিবে না। তা মা, এক ছেলে থাকিলে ওইরকমই হয়। আর নলিনের মতো ছেলেই বা কজন মায়ের হয়। সত্য বলিতেছি, আমি এক-একবার ভাবি– নলিন তো আমার বাপ, ও আমার জন্তে যতটা করিয়াছে আমি কি উহার জন্তে ততটা করিতে পারি। ওই দেখো, আবার নলিনের কথা । কিন্তু আর নয়, যাও মা, তুমি শুইতে যাও। না না, সে কিছুতেই হইতে পরিবে না, তুমি যাও– তুমি থাকিলে আমার ঘুম আসিবে না। বুড়োমানুষ, লোক কাছে থাকিলেই কেবল বকিতে ইচ্ছা করে।”