পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 og রবীন্দ্র-রচনাবলী আজ পর্যন্ত কোনো রান্না খাইয়া কোনো দিন ভালোমন্দ কিছুই বলে নাই কাল তোমার রান্নার প্রশংসা তাহার মুখে ধরে না মা । কিন্তু তোমার মুখখানি আজ বড়ো শুকনো দেখাইতেছে যে ? শরীর কি ভালো নাই ?” মলিন মুখে একটুখানি হাসি আনিয়া কমলা কহিল, “বেশ আছি মা ।” ক্ষেমংকরী মাথা নাড়িয়া কহিলেন, “না না, বোধ করি তোমার মন কেমন করিতেছে। তা তো করিতেই পারে, সেজন্য লজ্জা কিসের। আমাকে পর ভাবিয়ে না মা। আমি তোমাকে আপন মেয়ের মতোই দেখি, এখানে যদি তোমার কোনো অস্থবিধা হয়, বা তুমি আপনার লোক কাহাকেও দেখিতে চাও তো আমাকে না বলিলে চলিবে কেন ?” কমলা ব্যগ্র হইয়া কহিল, “না মা, তোমার সেবা করিতে পারিলে আমি আর কিছুই চাই না।” ক্ষেমংকরী সে কথায় কান না দিয়া কহিলেন, “নহয় কিছু দিনের জন্য তোমার খুড়ার বাড়িতে গিয়া থাকে, তার পরে যখন ইচ্ছা হয় আবার আসিবে।” কমলা অস্থির হইয়া উঠিল ; কহিল, "মা, আমি যতক্ষণ তোমার কাছে আছি সংসারে কাহারও জন্য ভাবি না। আমি যদি কখনো তোমার পায়ে অপরাধ করি আমাকে তুমি যেমন খুশি শাস্তি দিয়ে, কিন্তু এক দিনের জন্যও দূরে পাঠাইয়ে না।” ক্ষেমংকরী কমলার দক্ষিণ কপোলে দক্ষিণ হস্ত বুলাইয়া কহিলেন, “তাই তো বলি মা, আর জন্মে তুমি আমার মা ছিলে। নহিলে দেখিবামাত্র এমন বন্ধন কী করিয়া হয়। তা, যাও মা, সকাল-সকাল শুইতে যাও । সমস্ত দিন তো এক দণ্ড বসিয়া থাকিতে জান না।” কমলা তাহার শয়নগৃহে গিয়া, দ্বার রুদ্ধ করিয়া, দীপ নিবাইয়া, অন্ধকারে মাটির উপরে বসিয়া রহিল। অনেক ক্ষণ বসিয়া, অনেক ক্ষণ ভাবিয়া, এই কথা সে মনে বুঝিল, ‘কপালের দোষে যাহার উপরে আমার অধিকার হারাইয়াছি তাহাকে আমি আগলাইয়া বসিয়া থাকিব, এ কেমন করিয়া হয়। সমস্তই ছাড়িবার জন্য মনকে প্রস্তুত করিতে হইবে ; কেবল সেবা করিবার স্থযোগটুকু, যেমন করিয়া হউক, প্রাণপণে বঁাচাইয়া চলিব। ভগবান করুন, সেটুকু যেন হাসিমুখে করিতে পারি ; তাহার বেশি আর-কিছুতে যেন দৃষ্টি না দিই। অনেক দুঃখে যেটুকু পাইয়াছি সেটুকুও যদি প্রসন্নমনে না লইতে পারি, যদি মুখ ভার করি, তবে সব-স্থদ্ধই হারাইতে হইবে।” এই বুঝিয়া একাগ্রমনে বার বার করিয়া সে সংকল্প করিতে লাগিল, “আমি কাল হইতে যেন কোনো দুঃখকে মনে স্থান না দিই, যেন এক মুহূর্ত মুখ বিরস না করি, যাহা