পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 ob” রবীন্দ্র-রচনাবলী করিয়া কাজ করিবেন, আমাদের তাগিদ দেওয়াটা ভালো হইতেছে না। হেমের মনের ভাব আমি অবশু বুঝি না— কিন্তু আমি নলিনের কথা বলিতে পারি, সে এখনো মন স্থির করিতে পারে নাই ।” এ কথাটা ক্ষেমংকরী হেমনলিনীকে বিশেষ করিয়া শুনাইবার জন্যই বলিলেন । হেমনলিনী অপ্রসন্নমনে চিন্তা করিতেছে, আর তার ছেলেই ষে বিবাহের প্রস্তাবে একেবারে নাচিয়া উঠিয়াছে, এ ধারণা তিনি অপর পক্ষের মনে জন্মিতে দিতে পারেন না । হেমনলিনী আজ এখানে আসিবার সময় খুব একটা চেষ্টাকৃত উৎসাহ অবলম্বন করিয়া আসিয়াছিল ; সেই জন্য তাহার বিপরীত ফল হইল । ক্ষণিক উত্তেজনা একটা গভীর অবসাদের মধ্যে বিপর্যস্ত হইয়া পড়িল । যখন ক্ষেমংকরীর বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিল তখন হঠাৎ তাহার মনকে একটা আশঙ্কা আক্রমণ করিয়া ধরিল— যে নুতন জীবনযাত্রার পথে সে পদক্ষেপ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে তাহ। তাহার সম্মুখে অতিদুরবিসর্পিত দুর্গম শৈলপথের মতো প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিল । সমস্ত শিষ্টালাপের মধ্যে নিজের প্রতি অবিশ্বাস হেমনলিনীর মনকে আজ ভিতরে ভিতরে ব্যথিত করিতে লাগিল । এই অবস্থায় যখন ক্ষেমংকরী বিবাহের প্রস্তাবটাকে কতকটা প্রত্যাখ্যান করিয়া লইলেন, তখন হেমনলিনীর মনে দুই বিপরীত ভাবের উদয় হইল। বিবাহবন্ধনের মধ্যে শীঘ্র ধরা দিয়া নিজের সংশয়দোলায়িত দুর্বল অবস্থা হইতে শীঘ্ৰ নিষ্কৃতি পাইবার ইচ্ছা তাহার থাকাতে প্রস্তাবটাকে সে অনতিবিলম্বে পাকা করিয়া ফেলিতে চায়, অথচ প্রস্তাবট চাপা পড়িবার উপক্রম হইতেছে দেখিয়া উপস্থিতমত সে একটা আরামও পাইল । ক্ষেমংকরী কথাটা বলিয়াই হেমনলিনীর মুখের ভাব কটাক্ষপাতের দ্বারা লক্ষ্য করিয়া লইলেন। তাহার মনে হইল, যেন এতক্ষণ পরে হেমনলিনীর মুখের উপরে একটা শাস্তির স্নিগ্ধতা অবতীর্ণ হইল। তাহাতে র্তাহার মনটা তৎক্ষণাং হেমনলিনীর প্রতি বিমুখ হইয়া উঠিল। তিনি মনে মনে কহিলেন, “আমার নলিনকে আমি এত সস্তায় বিলাইয়া দিতে বসিয়াছিলাম !’ নলিনাক্ষ আজ যে আসিতে দেরি করিতেছে হৈাতে তিনি খুশি হইলেন। হেমনলিনীর দিকে চাহিয়া কহিলেন, "দেখেছ নলিনাক্ষের আঙ্কেল ? তোমরা আজ এখানে আসিবে সে জানে, তবু তাহার দেখা নাই। আজ নাহয় কাজ কিছু কমই করিত। এই তো আমার একটু ব্যামো হলেই সে কাজকর্ম বন্ধ করিয়া বাড়িতেই থাকে, তাহাতে এতই কী লেখি হয় ?”