পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি - 83వి চোখে যেন জল ভরিয়া আসিতে চাহিতেছিল। কিন্তু হেমনলিনীর কেমন-একটা দূরত্ব আছে— তাহাকে কোনো কথা বলা যেন চলে না, তাহাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে যেন বাধে । আজ কমলার সকল কথাই হেমনলিনীর কাছে প্রকাশ পাইয়াছে, কিন্তু সে আপনার সুগভীর নিস্তব্ধতার মধ্যে প্রচ্ছন্ন হইয়া চলিয়া গেল, কেবল একট-কী রাখিয়া গেল যাহা বিলীয়মান গোধূলির মতো অপরিমেয় বিষাদের বৈরাগ্যে পরিপূর্ণ। গৃহকর্মের অবকাশকালে আজ সমস্ত দিন কেবলই হেমনলিনীর কথাগুলি এবং তাহার শাস্ত-সকরুণ চোখের দৃষ্টি কমলার মনকে আঘাত দিতে লাগিল। কমল৷ হেমনলিনীর জীবনের আর-কোনো ঘটনা জানিত না— কেবল জানিত, নলিনাক্ষের সঙ্গে তাহার বিবাহের সম্বন্ধ হইয়া ভাঙিয়া গেছে। হেমনলিনী তাহাদের বাগান হইতে আজ এক সাজি ফুল আনিয়া দিয়াছিল। বৈকালে গা ধুইয়া আসিয়া কমলা সেই ফুলগুলি লইয়া মালা গাঁথিতে বসিল । মাঝে একবার ক্ষেমংকরী আসিয়া তাহার পাশে বসিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “আহা মা, আজি হেম যখন আমাকে প্রণাম করিয়া চলিয়া গেল, আমার মনের মধ্যে যে কী করিতে লাগিল বলিতে পারি না। ষে যাই বলুক, হেম মেয়েটি বড়ো ভালো। আমার এখন কেবলই মনে হইতেছে, উহাকে যদি আমাদের বউ করিতাম তো বড়ো স্বখের হইত। আর-একটু হইলেই তো হইয়া যাইত, কিন্তু আমার ছেলেটিকে তো পারিবার জো নাই— ও ষে কী ভাবিয়া বাকিয়া বসিল তা সে ওই জানে।” .. শেষকালে তিনিও যে এই বিবাহের প্রস্তাবে বিমুখ হইয়াছিলেন সে কথা ক্ষেমংকরী অার মনের মধ্যে আমল দিতে চান না। 源 বাহিরে পায়ের শব্দ শুনিয়া ক্ষেমংকরী ডাকিলেন, “ও নলিন, শুনে যা ।” কমলা তাড়াতাড়ি আঁচলের মধ্যে ফুল ও মালা ঢাকিয়া ফেলিয়া মাথায় কাপড় তুলিয়া দিল। নলিনাক্ষ ঘরে প্রবেশ করিলে ক্ষেমংকরী কহিলেন, “হেমরা ষে আজ চলিয়া গেল তোর সঙ্গে কি দেখা হয় নাই ?” নলিন কহিল, “ই, আমি যে তাহদের গাড়িতে তুলিয়া দিয়া আসিলাম।” ক্ষেমংকরী কহিলেন,“ষাই বলিস বাপু, হেমের মতো মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না।” যেন নলিনাক্ষ এ সম্বন্ধে বরাবর তাহার প্রতিবাদ করিয়াই আসিয়াছে। নলিনাক্ষ চুপ করিয়া একটুখানি হাসিল। ক্ষেমংকরী কছিলেন, “হাসলি যে বড়ো ! আমি তোর সঙ্গে হেমের সম্বন্ধ করিলাম, আশীৰ্বাদ পর্যন্ত করিয়া আসিলাম, আর তুই যে জের করিয়া সব ভণ্ডুল করিয়া দিলি, এখন তোর মনে কি একটু অস্থতাপ হইতেছে না " . . . 輸