পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি 8OS তো কোনোদিন হয় নাই। কমলা তাহার মনের মধ্যে অসমাপ্ত কাজের একটা ভার বহন করিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল। খানিকটা দূর গিয়া সে হঠাৎ থামিল, স্থির হইয়া দাড়াইয়া কী-একটা ভাবিল। তার পরে আবার ধীরে ধীরে ফিরিয়া আসিয়া উপাসনা-ঘরের দ্বারের কাছে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তাহাকে যে কিসে আবিষ্ট করিয়া ধরিল তাহা সে জানে না ; সমস্ত জগৎ তাহার কাছে ছায়ার মতো হইয়া আসিল, সময় যে কতক্ষণ চলিয়া গেল তাহা তাহার বোধ রহিল না । হঠাৎ এক সময় দেখিল, নলিনাক্ষ ঘর হইতে বাহির হইয় তাহার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। কমলা মুহূর্তের মধ্যে উঠিয়া দাড়াইয়া তখনি ভূতলে হাটু গাড়িয়া একেবারে নলিনাক্ষের পায়ের উপর মাথা ঠেকাইয়া প্ৰণাম করিল— তাহার সপ্তমানে আর্দ্র চুলগুলি নলিনের পা ঢাকিয়া মাটিতে ছড়াইয়া পড়িল। কমলা প্ৰণাম করিয়া উঠিয়া পাথরের মূর্তির মতো স্থির হইয়া দাড়াইল ; তাহার মনে রহিল না যে, তাহার মাথার উপর হইতে কাপড় পড়িয়া গেছে ; সে যেন দেখিতেই পাইল না, নলিনাক্ষ অনিমেষ স্থিরদৃষ্টিতে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া আছে– তাহার বাহজান লুপ্ত, সে একটি অস্তরের চৈতন্যআভায় অপূৰ্বরূপে দীপ্ত হইয়া অবিচলিতকণ্ঠে কহিল, “আমি কমলা।” এই কথাটি বলিবার পরেই তাহার আপনার কণ্ঠস্বরে তাহার যেন ধ্যানভঙ্গ হইয়া গেল, তাহার একাগ্র চেতনা বাহিরে ব্যাপ্ত হইল। তখন তাহার সর্বাঙ্গ কঁাপিতে লাগিল ; মাথা নত হইয়া গেল ; সেখান হইতে নড়িবারও শক্তি রহিল না, দাড়াইয়া থাকাও যেন অসাধ্য হইয়া উঠিল ; সে তাহার সমস্ত বল, সমস্ত পণ ‘আমি কমলা’ এই একটি কথায় নলিনাক্ষের পায়ের কাছে উজাড় করিয়া ঢালিয়া দিয়াছে— নিজের কাছে নিজের লজ্জা রক্ষা করিবার কোনো উপায় সে আর হাতে রাখে নাই, এখন সমস্তই নলিনাক্ষের দয়ার উপরে নির্ভর । নলিনাক্ষ আস্তে আস্তে তাহার হাতটি আপনার হাতের উপর তুলিয়া লইয়া কহিল, “আমি জানি, তুমি আমার কমলা। এসো, আমার ঘরে এসো।” উপাসনা-ঘরে তাহাকে লইয়া গিয়া তাহার গলায় কমলার গাথা সেই মালাটি পরাইয়া দিল এবং কহিল, “এসো, আমরা তাহাকে প্রণাম করি।” দুই জনে পাশাপাশি যখন সেই শ্বেতপাথরের মেজের উপরে নত হইল, জানল হইতে প্রভাতের রৌদ্র দুই জনের মাথার উপরে জাসিয়া পড়িল । প্রণাম করিয়া উঠিয়া জার-একবার নলিনাক্ষের পায়ের ধুলা লইয়া যখন কমল৷ দাড়াইল তখন তাহার দুঃসহ লজ্জা আর তাহাকে পীড়ন করিল না। হর্ষের উল্লাস নহে, কিন্তু একটি বৃহৎ মুক্তির আচঞ্চল শাস্তি তাহার অস্তিত্বকে প্রভাতের অকুষ্ঠিত